১৫ নভেম্বর, ২০০৭, সকাল ৯:৩৭
আজ আমরা মিশর যাচ্ছি৷ এটুকু লিখেই একটা অদ্ভুত অনুভুতি হল৷ যেন এখনো বিশ্বাসই করতে পারছি না৷ মনে হচ্ছে একটা স্বপ্ন দেখছি, এখনি ভেঙে যাবে৷ মিশরের সাথে প্রথম কবে পরিচয়! ..... অনেক ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে৷ কোন এক আনন্দমেলা পুজোসংখ্যায় বেরিয়েছিল শৈলেন ঘোষের গল্প৷ এক ফারাও আর তার ছোট্টো মেয়েকে নিয়ে৷ সেই প্রথম ভালো লাগা৷ সুর্যদেবতা রা, মৃত্যুদেবতা আনুবিসের সাথে মিশরের রহস্যমাখা ইতিহাসে প্রথম প্রবেশ৷ বোধহয় জীবনের প্রথম রোম্যান্স!!
কিছু দিন পর বাবা স্কুল থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসেছিল একটা আনন্দমেলা৷ এখনো মনে আছে .... দুপুরে টিভিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর একটা সিনেমা হচ্ছিল৷ আমাদের টিভিবর্জিত ছোটোবেলায় শুধুমাত্র এই জাতীয় কিছু অনুষ্ঠান হলেই বিনোদনের নিষিদ্ধ জগতে প্রবেশের অনুমতি মিলতো৷ কিন্তু সেই নিষিদ্ধ জগতের আকর্ষনও সেদিন তুচ্ছ হয়ে গেছিল ঐ আনন্দমেলাটা পেয়ে৷ পত্রিকার প্রচ্ছদে কিশোর রাজা তুতানখামুনের মুখ আমার সম্মোহিত করে ফেলেছিল৷ সোনার মুখোসের নিচে তিনহাজার বছর ধরে শুয়ে আছে মিশরীয় কিশোর৷ তার সমাধিমন্দিরের দেওয়ালে আশ্চর্য উজ্জ্বল রঙে আশ্চর্য সব কাহিনী লেখা৷ নীলনদের জলে বয়ে যাওয়া কত ইতিহাস৷ কত নারীর দীর্ঘশ্বাস৷ তাদের স্বামী-পুত্রের রক্তজল করা কীর্তি আজও পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে৷ মিশর আমায় বিস্ময়াবিষ্ট করে রেখেছে সেই ছোটোবেলার দিনগুলি থেকে আজ পর্যন্ত৷ মিশর যেন বাস্তব হয়েও অবাস্তব, অপার্থিব এক দেশ৷ স্বপ্নে দেখা, গল্পে শোনা যে রূপকথা - সেই রূপকথার দেশ মিশর৷
আজ থেকে পাঁচবছর আগেও কল্পনা করিনি এই রূপকথার মাটিতে আমার পা পড়বে৷ কিন্তু গত কয়েকবছরে পৃথিবী এমন ছোটো হয়ে এসেছে - এখন বুঝি রূপকথাকেও ছোঁয়া সম্ভব৷ আমিও ছুঁতে চলেছি আর কিছুক্ষনের মধ্যেই৷ এখন আমরা প্লেনে৷ নিউ ইয়র্ক যাচ্ছি৷ জন এফ কেনেডী এয়ারপোর্ট থেকে বিকেলে ছাড়বে কায়রোর ফ্লাইট৷ বেশি না৷ আর মাত্রই চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধান৷ তারপর? নাহ .... এখনো ভাবতে পারছি না :) এই ফাঁকে আমরা কোথায় কোথায় যাবো তার একটা হিসেব দিয়ে নিই৷
১৬ নভেম্বর - কায়রো পৌঁছাবো দুপুর নাগাদ৷ যদি খুব টায়ার্ড না থাকি তাহলে খাল-এল-খালিল নামে কায়রোর বিখ্যাত বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা আছে৷ প্রাচীন এই বাজার মশলার জন্য বিখ্যাত৷ শুভর ইচ্ছা আছে এই বাজারে বসে হুঁকো টানার :) দেখা যাক এই প্ল্যান কতদুর সফল হয়৷
১৭ নভেম্বর - ভোর বেলায় লাক্সরের প্লেন ধরতে হবে৷ লাক্সর থেকে ছাড়ছে আমাদের নাইল ক্রুজ৷ নীলনদের ওপর তিনদিন ঘুরে বেরাবো প্রমোদতরনীতে :) মাঝে মাঝে তরী ভিড়বে তীরে৷ মিশরের প্রাচীন ইতিহাসের দরজাগুলো খুলে যাবে একে একে৷ লাল মাটির পথ বেয়ে আমরা পৌঁছে যাবো সেই সময়ে যখন শুরু হয়েছিলো পৃথিবীর প্রথম আধুনিক সভ্যতা৷
১৭ তারিখ আমরা ঘুরছি ভ্যালি অফ কিংস, ভ্যালি অফ কুইন্সে৷ এই সমাধিগুলো আনুমানিক দেড়হাজার খ্রীষ্টপুর্বাদের৷ পিরামিডের পরের যুগের ফারওরা এখানে সমাধিস্থ হয়েছে৷ শুধু ফারাও নয়, তাদের আত্মীয়রাও৷ এমনকি অনেক সময় রাজ পরিবারের সাথে সম্পর্কিত অভিজাতরাও৷এদিন আরো দেখছি রানী হশেপসুতের মন্দির৷ ক্লিওপেট্রাকে বাদ দিলে এই রানীই মিশরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মহিলা ফারাও৷ আনুমনিক দেড়হাজার খ্রীষ্টপুর্বাব্দ নাগাদ ইনি বাইশ বছর রাজত্ব করেন৷ এর মৃত্যুর পর এর সব চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছিল রাজপরিবারের ইতিহাস থেকে৷ মেয়ে হয়ে পুরুষের কাজ করার শাস্তি!!
১৭ তারিখ আরো দেখছি কলোসি অফ মেনন৷ নীলনদের তীরে আমেনহোতেপের এই বিশাল মুর্তি থেকে একসময় অদ্ভুত সব আওয়াজ বেরোতো৷ লোকে ভাবতো দেবতা অসন্তুষ্ট হয়েছেন৷ তারপর একবার মুর্তিটি মেরমত করতে গিয়ে এই আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায় :)
১৮ নভেম্বর - এদিন যাবো কার্নাক টেম্পলে৷ প্রাচীন পৃথিবীর সব চেয়ে বড়ো ধর্মস্থান যা আজও টিকে আছে৷
১৯ নভেম্বর - অশ্বচালিত শকটে চেপে এই দিন যাচ্ছি দুই হাজার বছরের পুরোনো হোরাসের মন্দিরে৷ আইসিস আর ওসিরিসের ছেলে হোরাস - খুব ইন্টারেস্টিং গল্প আছে এই হোরাসের জন্ম নিয়ে৷ ভুমিদেব গেব আর আকাশদেবী নুতের দুই ছেলে - ওসিরিস আর সেথ৷ ওসিরিস দক্ষিন মিশরের রাজা - জমি যেখানে রুক্ষ, পাথুরে, বছরে এক দিন বৃষ্টি হয় কি হয় না৷ আর তার ভাই সেথ রাজত্ব করেন উত্তর মিশরে নীলনদের শস্যশ্যামলা মোহানায়৷ এদের আরো দুই বোন আছে - আইসিস আর নেফতিস৷ মিশরের রীতি অনুযায়ী ভাই-বোনের সম্পর্ক অতি পবিত্র বিবাহ সম্পর্ক৷ গেব আর নুতও সহোদর ভাই বোন৷ তো সেই মত সেথের সাথে নেফতিসের আর ওসিরিসের সাথে আইসিসের বিয়ে হয়৷ ওসিরিস খুব জনপ্রিয় রাজা৷ সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ সেথের সেটা সহ্য হয়না৷ সে হিংসায় জ্বলতে থাকে৷ সেথের বৌ নেফতিসও লোকপ্রিয় ওসিরিসের অনুরক্ত৷ সেথ তাই ওসিরিসকে হত্যা করে৷ শুধু মেরে ফেলেই শন্ত হয়না৷ ওসিরিসের দেহ চোদ্দোটি টুকরো করে ছড়িয়ে দেয় মিশরের পথেঘাটে৷ আইসিস ওসিরিসকে খুঁজে বেড়ায়৷ ওসিরিসের দেহের টুকরোগুলো একে একে উদ্ধার হতে থাকে৷ প্রানহীন টুকরোগুলোকে নিয়ে কাপড়ে জড়িয়ে সুগন্ধি মাখিয়ে মমি তৈরী করে৷ কিন্তু এভাবেই কি শেষ হয়ে যাবে মিশরের প্রাণের মানুষ ওসিরিস - এমনকি কোন উত্তরাধিকারী না রেখেই!! জ্ঞানের দেবতা থথ তখন আইসিসকে জাদুবিদ্যা শেখান৷ একদিনের জন্য মৃত ওসিরিসের দেহে প্রাণসৃষ্টি হয়৷ হোরাসের জন্মের বীজ বপন করে এবার চিরকালের জন্য মৃত্যুর জগতে পা বাড়ান ওসিরিস৷ তখন থেকে মিশরের রাজা ওসিরিস হলেন মৃত্যুর দেশের রাজা৷ আর আইসিস রইলেন পৃথিবীতেই৷ মমতা ও রোগমুক্তির দেবী হয়ে৷
২০ নভেম্বর - এইদিন যাচ্ছি অসোয়ানের বিখ্যাত বাঁধ দেখতে৷ এটা অবশ্য প্রাচীন পৃথিবীর নিদর্শন নয় ষাটের দশকে তৈরী৷ তারপর যাবো রানী হশেপসুতের আমলে তৈরী হওয়া অসমাপ্ত ওবেলিস্ক দেখতে৷ তৈরী শুরু হওয়ার কিছুদিন পর এটা কোন কারনে পরিত্যক্ত হয়৷ সাড়ে তিন হাজার বছর আগের মানুষেরা কি ভাবে পাথর কেটে কেটে এই বিশাল তোরনগুলো বানিয়েছিল তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় এই অসমাপ্ত ওবেলিস্কটা দেখলে৷ তারপর যাবো ফিলিতে আইসিসের মন্দির দেখতে৷ আইসিসের গল্প তো আগেই বলেছি৷ আইসিসের পুজা একসময় মিশরে এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে আইসিসের নাম মিশর ছড়িয়ে পৌঁছে যায় গ্রীস-রোমে৷ গ্রীক দেবী আফ্রোদাইত আর আইসিসের মধ্যে মিল খুঁজে পান কেউ কেউ৷
২১ নভেম্বর - পিরামিড, স্ফিংক্স আর ইজিপ্সিয়ান মিউসিয়াম দেখবো৷ তুতানখামুনের সোনার মুখোশ - আনন্দমেলায় প্রচ্ছদে যার ছবি দেখে প্রথম পাগল হয়েছিলাম - সেই মুখোশ দেখবো নিজের চোখে - স্বপ্ন নয়, সত্যিকারের মুখোশ!!
২২ তারিখ ঘরে ফেরা৷
১৫ নভেম্বর, বিকেল ৩:৪৬, জে এফ কে এয়ারপোর্ট
এখন এয়ারপোর্টে৷ সিকিউরিটি চেক-ইন হয়ে গেছে৷ বসে আছি প্লেনের অপেক্ষায়৷ দুপুরে জ্যাকসন হাইটসে বেশ ভালই পেটপুজো হল৷ একটা পাকিস্তানী দোকানে দুর্দান্ত শামি কাবাব আর নিহারী খেলম৷ আমার পেটুক বর প্রথমেই আমার অলক্ষ্যে চারখানা নানের অর্ডার দিয়ে বসলো৷ অতিকষ্টে তিনখানা খাওয়া গেল৷ হাল্কা জিরের গন্ধওয়ালা সুস্বাদু গরুর মাংসের ঝোল নিজামের বিফকারীর দিনগুলোকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছিলো৷ সব শেষে গাজরের হালুয়া দিয়ে মিষ্টি মুখ৷ এতো ভালো গাজরের হালুয়া আমরা কোত্থাও খাই নি৷ আর কিছু না হোক এই গাজরের হালুয়ার জন্যই আজ নিউ ইয়র্ক আসা সার্থক :) আমাদের রেস্টোরান্টের পাশে দেখলাম দিব্যি সালোয়ার কামিজ আর শাড়ী বিক্রি হচ্ছে৷ জল থৈ থৈ জ্যাকসন হাইটস, সরু রাস্তা, রাস্তার ধারে শামী কাবাব আর শাড়ীর দোকান পাশাপাশি - সব মিলিয়ে একদম গড়িয়াহাট৷ আপাতত গড়িয়াহাটের মায়া ছেড়ে জে এফ কের ছত্রছায়ায়৷ আর কিছুক্ষনের মধ্যেই উড়ে যাবো মিশরের পথে!!
১৬ নভেম্বর, বিকেল ৪:৩০, কায়রো
আজ দুপুর দুটো নাগাদ এসে পৌঁছেছি৷ প্লেন থেকে দেখলম রুক্ষ মাটি, ধুষর বালিতে ঢাকা - তার মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু বহুতল - উঁকি মারছে কায়রো শহর৷ এয়ারপোর্টে গেটওয়ান ট্রাভেলসের লোক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো৷ কাস্টমস অফিসারটি আমাদের দেশের অফিসারদের মতই খেঁকুরে টাইপের৷ পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মেরে উদ্ধার করে দিলো - এই রকম একটা ভাব৷ এয়ারপোর্ট থেকে বাসে হোটেলে এলাম৷ লাউঞ্জে অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পর চাবি হাতে এলো৷ টুরিজম এদেশের অন্যতম প্রধান বিজনেস৷ সেই অনুপাতে এখানকার মানুষ যতখানি হসপিটেবল হবে ভেবেছিলাম তা কিন্তু মনে হচ্ছে না৷ আমার ইউনিভার্সিটির ইজিপসিয়ান সহপাঠীও অবশ্য এই কথাই বলেছিল৷খাল-এল-খালিলের প্ল্যান ক্যানসেল৷ নতুন দেশে এসেই একা একা বাজারে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না৷ তার বদলে পিরামিডের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখতে যাচ্ছি৷ ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আর মাত্র দুঘন্টা পরেই আমি পিরামিড দেখবো৷ রূপকথা সামনে এসে দাঁড়াবে!!
১৮ নভেম্বর, সকাল ৮:৪৫, নীলনদ
গত দুদিনে যা যা দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করবো এমন ক্ষমতা আমার নেই৷ কথাটা খুব ক্লিশে শোনালেও সত্যি৷এতোদিন যা শুধু বইএর পাতায়, টিভির পর্দায় আর কল্পনার চালচিত্রে দেখে এসেছি তা নিজের চোখের সামনে দেখা, শুধু দেখাই নয় হাত দিয়ে ছোঁয়া - আমার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে৷
১৬ তারিখের সন্ধ্যা দিয়ে শুরু করি৷ বাসে করে আমাদের ওল্ড কায়রো নিয়ে যাওয়া হল৷ অনেকক্ষনের রাস্তা৷ কায়রোর রাস্তায় সিগনালের কোন বালাই নেই৷ যে যার নিজের ইচ্ছামত গাড়ি চালাচ্ছে এবং অবশ্যম্ভাবী অ্যাক্সিডেন্টগুলো ও নিপুণ কুশলতায় বাঁচিয়ে চলেছে৷ সেদিন ছিলো শুক্রবার৷ কায়রো শহরে অজস্র মসজিদ৷ খুব সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো৷ একটা মসজিদে বেশ ভীড় দেখলাম৷ আমাদের গাইড মিমো জানালো ওখানে বিয়ে হচ্ছে৷ আমাদের হোটেলেও সেদিন একটা বিয়ের রিসেপশন হচ্ছিলো৷
কায়রোর মেয়েদের পোষাক বেশ বৈপরিত্যে ভরা৷ বিয়েতে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আপদমস্তক বোরখাধারিনীও আছে, আবার অফশোল্ডার সাহসিনীও আছে৷ তবে রাস্তায় কোন অফশোল্ডার চোখে পরলো না, এমনকি কোন ওয়েস্টার্ন আউটফিটও না৷ রাস্তায় সবাই বোরখা৷ মুখ খোলা অবশ্য৷ ছেলেরা বেশিরভাগই সাধারন শার্টপ্যান্ট৷ কিছু এখান্কার ট্র্যাডিশনাল পোষাক পরা৷ লম্বা ঢিলেঢালা আলখাল্লা টাইপের পোষক - নাম গালাবা৷ কায়রোর রাস্তা দেখতে দেখতে দেশের কথা মনে পড়ছিলো৷ ঐ রকমই ট্রাফিক আইন না মানা মানুষ, ঐ রকমই স্টেশনারী দোকান রাস্তার ওপর৷ কতোদিন পর টিনের শাটার দেখলাম :) পথে পড়লো মহম্মদ আলি মস্ক৷ আঠারো শতকের তৈরী এই মসজিদের অপুর্ব স্থাপত্য৷ রাতের আলোয় আরো মোহময়ী লাগছিলো৷ আমার ইচ্ছা ছিলো এটা দেখার৷ কিন্তু আমাদের আইটিনেরারীতে ছিলো না৷ রাস্তায় দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগলো৷ তবে ছবি নেওয়া গেল না - এই যা দু:খ৷
মিমো আমাদের নিয়ে এলো একটা ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যে৷ পাশে কোন মসজিদ থেকে তখন জোরে আজান দিচ্ছে৷ গাড়ীর হর্ণ, অজস্র বাস, গিজগিজে ভীড় - মনে হচ্ছিল দিল্লীতে আছি৷ একটা বড় দেওয়ালের
গায়ে লেখা "গিজা সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শো"৷ দেওয়ালের গায়ে একটা ছোটো জানলা৷ সেখান থেকে টিকিট বিক্রি হচ্ছে৷ টিকিট কেটে দেওয়ালের ওপারে গিয়ে পুরো একমিনিট মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোলো না৷ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে খেওপস, খেফরু আর মিসেরিনাসের তিনটি পিরামিড আর তাদের সামনে উজ্জ্বল নীল আলোয় জ্বলজ্বল করছে স্ফিংক্স৷ আমার মনে হল জীবন সার্থক হয়ে গেছে৷ এই আঠাশ বছর পর্যন্ত আমায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাকে যে ধন্যবাদ দিলাম জানি না৷ মনে হল জীবনের এক মাইলস্টোন পেরিয়ে এলাম৷
সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শোতে স্ফিংক্সের মুখ দিয়ে মিশরের ইতিহাস বলানো হল৷ জানা গল্প, নেট ঘাঁটলেই আজকাল পড়া যায়৷ কিন্তু ঐ সময়ে পিরামিডের সামনে বসে ঐ শোনা গল্পগুলো ই আবার শুনতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো৷ সাড়ে চারহাজার বছরের পুরোনো এই পিরামিড৷ একসময় বাইরের পাথরগুলো এতো চকচকে ছিলো যে সুর্যের রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সারা মিশর এর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো৷ আমুন-রায়ের পুরোহিতেরা দেখেছে এই পিরামিড, রামেসিস, আমুনহোতেপ, রানী হাতশেপসুত, কিশোর রাজা তুতানখামুন, ব্যক্তিত্বময়ী ক্লেওপেট্রা, ইতিহাসের জনক হেরোডেটাস, দিগবিজয়ী আলেকজান্ডার, শত শত গ্রীক, রোমান, মুসলিম, খ্রীষ্টান সৈনিক - আর আজ আমরাও দেখলাম এই অতুলনীয় সৃষ্টি৷ অতুলনীয় কারন এটা মানুষের হাতে গড়া৷ আজকের মানুষ নয়, সাড়ে চারহাজার বছর আগের মানুষ - এমন পুর্বপুরুষের কথা ভাবলে মনে গর্ব হয়, অনুপ্রেরনা জাগে৷ আর কিছুদিন পর আমরা কোন অতলে চলে যাবো৷ কিন্তু এই পিরামিড থাকবে৷ আমরা যে এখানে এসেছিলাম মনে রাখবে কি? আমরা এই ইতিহাসের একটা বিন্দু হয়ে বেঁচে থাকবো কি? এই বিশালত্বের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম অনুভব করতে পারছি মানুষের অমর হওয়ার ইচ্ছা কি প্রবল! মানুষ শুধু বাঁচতে চায় না৷ ছাপ ফেলে যেতে চায়৷ "আনন্দাত্ জায়তে বিশ্ব, আনন্দাত্ পল্যতে তথা, আনন্দাত্ লীয়তে বিশ্ব, আনন্দ পরিপুরত:"৷ মানুষ চলে যাওয়ার পরেও এই পৃথিবীতে তার আনন্দটুকু রেখে যায়৷ পৃথিবীর আকাশে-বাতাসে তার আনন্দকণা ভেসে থাকে৷ পরের প্রজন্মের মানুষ সেই আনন্দ আঁজলা ভরে তুলে নেয়৷ আজ যেমন আমরা আড়াইহাজার খ্রীষ্টপুর্বাব্দের বুদ্ধি-শ্রম আর সৃষ্টির আনন্দ আকণ্ঠ পান করলাম৷
এতক্ষন কেবিনে বসে লিখছিলাম৷ এবার ডেকে উঠে এলাম৷ ভীষন ভালো লাগছে নীলনদের ওপর ভেসে বেড়াতে৷ আমার এক পাশে রুক্ষ পাহাড়, অপর পাশে সবুজ৷ কিন্তু সে কথা পরে৷ আগে কালকের গল্প বলে নিই৷
কাল ভোর দুটোতে উঠতে হয়েছে৷ লুক্সরের ফ্লাইট ছিল ভোর পাঁচটায়৷ লুক্সরে নেমে লাগেজ কালেক্ট করেই সাইট সিইং নাইলের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে৷ নীলনদের পশ্চিম উপকুল রুক্ষ, ধুষর, পাথুরে৷ ফারওরা তাই এই তীরটাকে বেছে নিয়েছিল তাদের শান্তিতে ঘুমনোর জায়গা হিসেবে৷ এই সমাধিগুলো কিন্তু পিরামিড নয়৷ পিরামিডগুলো সবই চার সাড়েচারহাজার বছর আগে তৈরী৷ পিরামিডের প্রবেশপথ যদিও গোপন রাখা হত, কিন্তু তা সজ্জ্বেও চুরিডাকাতি সেই প্রাচীনকালেও কিছু কম হয়নি৷ পিরামিডের অতুলনীয় ধনসম্পদের লোভে সেই যুগেও বহু লোক পিরামিড ভেঙে ঢুকেছে৷ তাই পরবর্তীকালের ফারওরা লুক্সরের কাছে নীলনদের পশ্চিমকুলের পাথুরে জমিকে বেছে নিয়েছিল তাদের সমাধির জন্য৷ মাঠির নিচে সমাধিকক্ষ তৈরী করে তার মুখ এমনভাবে বন্ধ করে দেওয়া হত যাতে কেউ খুঁজে না পায়৷ এই সমাধিস্থলই ভ্যালি অফ কিংস আর ভ্যালি অফ কুইনস৷ ভ্যালি অফ কিংসে মুলত ফারওদের সমাধি দেওয়া হত৷ ভ্যালি অফ কুইনসে রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের৷
আমরা প্রথমে গেলাম ভ্যালি অফ কুইন্সে আমেন-খপ-শেফ নামে এক রাজকুমারের সমাধিতে৷ এই রাজকুমার তৃতীয় রামেসিসের বড়ছেলে৷ অল্পবয়সে মারা যায়৷ এর সমাধিটা ছোটো৷ কিন্তু সমাধিমন্দিরের দেওয়ালের ছবি প্রায় পুরোটাই অক্ষুন্ন আছে৷ আমাদের ইজিপ্টোলজিস্ট ভিভিয়ান তাই এই সমাধিকে বেছে নিয়েছিল আমাদের দেখানোর জন্য৷ মাটির লেভেলের একটু নিচে সমাধির প্রবেশপথ৷ প্রথমেই একটা করিডর ঢালু হয়ে নেমে গেছে ইনার চেম্বারের দিকে৷ ভেতরে ধুপ জ্বালিয়ে রেখেছে৷ তার মিষ্টি গন্ধে ভরে আছে সমাধির ভেতরটা৷ করিডরের দেওয়ালে তাকিয়ে চোখের পলক পড়ছিলো না৷ কে বলবে এই রঙ সাড়ে তিনহাজার বছরের পুরোনো৷ যদিও আমরা দেখছিলাম কাচের আবরনের এপাশ থেকে - তবুও বুঝতে পারছি এক আশ্চর্য কীর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ কিশোর রাজপুত্রের সাথে বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি আঁকা - যাদের কাছে তাকে মৃত্যুর ওপারে গিয়ে জবাবদিহি করতে হবে৷ একশো ছাব্বিশটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারলে তবে খুলবে স্বর্গের দ্বার৷ করিডর দিয়ে শেষ হয়েছে ছোটো ইনার চেম্বারে৷ সেখানে পাথরের সার্কোফেগাস (কফিন) রাখা আছে৷ এর ভেতরে মমি ছিল৷ সেটা বার করে রাখা আছে মিউসিয়ামে৷ সমাধির মধ্যে ছবি নেওয়া বারন৷ তাই ছবি দেওয়া গেলো না৷ তবে যা দেখেছি তা মনের ক্যামেরায় চিরকালের মত ধরা রইলো৷
এর পর গেলাম ভ্যালি অফ কিংসে৷ এখানেও ছবি নেওয়া যাবে না৷ আমরা গেলাম চতুর্থ রামেসিস, নবম রামেসিস আর তুতানখামুনের সমাধিতে৷ তুতানখামুনের জন্য আলাদা টিকিট কাটতে হল ৮০ ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড দিয়ে৷ বাকিগুলো আমাদের প্যাকেজে ইনক্লুডেড৷ চতুর্থ রামেসিসের সমাধি বেশ বড়ো৷ এই সমাধি অব্যশ্য বহুদিন
আগেই আবিষ্কার হয়ে গেছে৷ এমনকি আঠারো শতকে এটা হোটেল হিসেবেও ব্যবহার হয়েছে৷ সমাধির মধ্যে হায়রোগ্লিফিক্সের ওপরে অনেক জায়গায় কোপটিক, ল্যাটিনে লেখা আছে৷ খ্রীষ্টান সন্যাসীদের কীর্তি৷ অনেকজায়গায় নিখুঁত ভাবে সমাধির দেওয়ালে খোদাই করা ছবি উপড়ে নেওয়া হয়েছে৷ তবে যেটুকু আছে সেটা একদম জ্বলজ্বল করছে৷ কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায়না এই ছবি তিনহাজারেরও বেশি বছরের পুরোনো৷ যে ঘরে রামেসিসের সারকোফেগাস রাখা আছে তার সিলিংএর ছবি অপুর্ব৷ মিশরীয় মিথ অনুযায়ী বায়ুদেবী নুত রোজ সন্ধ্যাকালে সুর্যদেবতা রাকে গিলে নেন আর রোজ ভোরে সুর্যদেবতা নুতের গর্ভ হতে জন্ম নেন৷ রামেসিসের সমাধির ইনার চেম্বারের সিলিংএর ছবিতে দেখা যাচ্ছে নুত রাকে গিলে নিচ্ছেন৷ তারপর সেই নুতের থেকেই আবার রায়ের জন্ম হচ্ছে৷ সুর্যের রঙ কি অসাধারন লাল৷ আকাশ উজ্জ্বল নীল৷ প্রায়ান্ধাকার ইনার চেম্বারেও সেই রঙ ঝলমল করছে৷ নবম রামেসিসের সমাধিও একইরকম৷ তবে বেশ ছোটো৷ আমাদের অশিক্ষিত চোখে খুব বেশি কিছু তফাত ধরা পড়লো না৷
তারপর গেলাম বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিখ্যত ফারাও তুতানখামুনের সমাধি দেখতে৷ খুব ছোটো সমাধি৷ তুতানখামুন তো খুব একটা বিখ্যাত রাজা ছিলেন না৷ খুব অল্প বয়সেই মারা যান৷ তুতানখামুন বিখ্যত হয়েছেন মৃত্যুর তিনহাজার বছর পরে যখন জেমস কার্টার তাঁর প্রায় অবিকৃত সমাধিমন্দির আবিষ্কার করে৷ আর কোনো ফারওএর সমাধি থেকে এতো সম্পদ পাওয়া যায়নি৷ তার মানে অবশ্য এই নয় যে তুতানখামুনের সময় মিশর কিছু অতিরিক্ত সমৃদ্ধিশালী ছিল৷ সব ফারাওদের সমাধিতেই প্রচুর ধনসম্পদ ছিলো, কিন্তু সে সবই চুরি গেছে৷ সৌভাগ্যবশত তুতানখামুনের কথা সবাই ভুলে গেছিল৷ তাই তাঁর সমাধির ওপর হামলা হয়নি৷ বিশ শতকে তাঁর সমাধির অতুলনীয় সম্পদ দেখে আজকের মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে গেছে৷ এই তুতানখামুনের ছবি আনন্দমেলার প্রচ্ছদে দেখেই আমার মিশর মুগ্ধতার সুত্রপাত৷ তুতানখামুনের সমাধির করিডরে বিশেষ ছবি নেই৷ রাজার মৃত্যু যেহেতু অপ্রত্যশিত ছিল তাই খুব তাড়াহুড়োয় বানানো হয় এই সহ্মাধি৷ ইনার চেম্বারে কাচের বাক্সে রাখা রয়েছে তুতানখামুনের মমি৷ এবছরের নভেম্বর মাসের চারতারিখে তুতানখামুনের মমি খোলা হয়েছে৷ তাই এই মুহুর্তে ইজিপ্টোলজিতে তুতানখামুনের মমি হল সবচেয়ে বড়ো খবর৷ মমি আমরা আগেও দেখেছি৷ ঐতিহাসিক গুরুত্ব যতই হোক না কেন, আমাদের অশিক্ষিত চোখে এটা যে আলাদা কিছু তা কিন্তু নয়৷ কিন্তু মাটির তলায় সমাধিমন্দিরে তিনহাজার বছরের পুরোনো কিশোরের দেহাবশেষ দেখে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো৷ তিনহাজার বছর! মহাকালের নিয়মে হয়তো কিছুই নয়৷ কিন্তু আমাদের নশ্বর জীবনে আমরা তো কল্পনাই করতে পারি না৷ আত্মাই শুধু জন্মরহিত ও শাশ্বত নয়, প্রাচীন মিশরীয়দের দেহকেও শাশ্বত করে রাখার উপায় জানা ছিল!! তুতানখামুনের সমাধির দেওয়ালের ছবিগুলো আশ্চর্য জীবন্ত৷ হয়তো মানুষের আনাগোনা বেশি হয়নি বলেই রঙ বিশেষ নষ্ট হয়নি৷ তুতানখামুনের সাথে আইসিসের ছবি আছে দেওয়াল জুড়ে৷ এতো উজ্জ্বল যে দেখে মনে হচ্ছে কালই আঁকা হয়েছে বুঝি৷
তারপর গেলাম রানী হাতশেপসুতের মন্দিরে৷ নির্দ্বিধায় প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মহিলা৷ সাড়েতিনহাজার বছর আগে বাইশ বছর মিশরের রাজত্ব চালিয়েছেন৷ হাতশেপসুত ছাড়া আর কোন মহিলা মিশরের সিংহাসনে এতোদিন বসার কথা ভাবেও নি৷ মিশরের ইতিহাসে আরো কয়েকজন মহিলা ফারাও দেখা গেছে ঠিকই৷ কিন্তু তারা রাজত্ব করেছে ঠেকায় পড়ে - ভাই বা স্বামী উপযুক্ত হয়ে উঠলেই তাকে রাজত্ব ছেড়ে দিয়েছে৷ হাতশেপসুত রাজা হন তাঁর বাবার মৃত্যুর পর দু বছরের জন্য৷ তারপর তাঁর স্বামী তৃতীয় থথমোসিসের মৃত্যুর পর টানা উনিশ বছর এব ংএই কাজে তিনি মিশরের পুরুষপ্রধান পুরোহিততন্ত্রের সম্মতি আদায় করে ছাড়েন৷ মিশরের ইতিহাসের অন্যতম সফল বহির্বাণিজ্য হয়েছে হাতশেপসুতের রাজত্বকালে৷ ইনফ্যাক্ট রানীর এই কীর্তিকে অমর করে রাখতেই প্রতিষ্ঠিত হয় এই মন্দির৷ পুণ্ট (বর্তমান সোমালিয়া) থেকে নিয়ে আসা কিছু গাছ পোঁতা হয়েছিলো মন্দিরের সামনে৷ সেই গাছ আর নেই, কিন্তু সেই জায়গা চিহ্নিত করা আছে এখনো৷ মন্দিরটাও বেশ অভিনব৷ মিশরের অন্যান্য মন্দিরগুলোর থেকে অন্যরকমের আর্কিটেকচার৷ তিনতলা মন্দির৷ অনেকটাই ভেঙে গেছে৷ কিছু ভেঙে দেওয়া হয়েছে৷ কিছু ভেঙে পড়েছে ধ্বস নেমে৷ এই প্রসঙ্গে বলে রাখি হাতশেপসুতের মৃত্যুর পর তার নাম মিশরের রাজপরিবারের রেকর্ড থেকে মুছে দেওয়া হয়৷ তার রাজত্বকালে যা কিছু প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তার অধিকাংশ থেকে তার নাম মুছে দিয়ে চতুর্থ থথমোসিসের নাম লেখা হয়৷ কিন্তু সেই মুর্খেরা "he" গুলোকে "she" করতে ভুলে গেছিল৷ কালের বিচারে তাদের ছলনা তাই শেষপর্যন্ত টিকলো না৷ হাতশেপসুত প্রকাশ পেলেন স্বমহিমায় তাঁর সময়ের সাড়ে তিনহাজার বছর পরে৷ হাতশেপসুতের মন্দিরের হায়রোগ্লিফিক্স অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে৷ মূল স্ট্রাকচারটা রয়েছে৷ তারই ছবি তুললাম৷ রোমাঞ্চিত হলাম সাড়েতিনহাজার বছর আগে পৃথিবীর প্রথম মহিলা শাসকের কথা ভেবে৷
রোদ চড়া হয়ে উঠেছে৷ এই নভেম্বর মাসেও ঘাম হচ্ছে৷ খিদেও পেয়েছে তেমন৷ সবাই শিপে ফিরে খাওয়ার জন্য ব্যস্ত৷ ফেরার পথে বাস থামলো কলোসি অফ মেমননের সামনে৷ নামটা গ্রীক শোনালেও এটা আসলে ফারাও তৃতীয় আমেনহোতেপের দুটো বিরাট মুর্তি৷ প্রায় ষাট ফুট উঁচু এই মুর্তি একটা মাত্র পাথর কেটে বানানো৷ এখন অবশ্য দেখে বোঝা যাবে না সেটা৷ একসময় ভুমিকম্পে এই মুর্তি ভেঙে যায়৷ তখন কোন একটা ফাটল দিয়ে হাওয়া ঢুকে কান্নার মতো আওয়াজ বেরোতো৷ গ্রীকরা এই কানা শুনে ওদের আগামেমননের গল্পের সাথে সেটা রিলেট করে নাম দিয়েছিল কলোসি অফ মেমন্নন৷ তারপর রোমান আমলে এই মুর্তির রিকনস্ট্রাকশনের সময় ফাটল জুড়ে যায়৷ আওয়াজও বন্ধ হয়৷ মেমনন আর কাঁদে না৷ ভাঙা মুর্তিদুটো অতীত গৌরবের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার সামনে ছবি তুললাম৷ মাত্র একটা পাথর কেটে কি করে বানানো যায় এই ষাটফুট উঁচু মুর্তি সাড়ে তিনহাজার বছর আগের টেকনোলজিতে - সেকথা ভেবে আবারও কোন কুলকিনারা করতে পারলাম না৷
ফিরে এসে এই প্রথম আমাদের কেবিনের ঘরে ঢুকলাম৷ আমাদের জাহাজের নাম কিং অফ থিবস৷ বেশ সুন্দর কেবিন৷ জানলা খুলে দিলেই সেটা ডেক হয়ে যাচ্ছে৷ ডেক থেকে উঁকি মারলাম নীলনদে৷ সেই ছোটোবেলা থেকে গঙ্গার পরেই সবচেয়ে পরিচিত নদী বোধহয় নীলনদ৷ গঙ্গা এতো ছোটো থেকে দেখছি যে প্রথম দেখার স্মৃতি বলে আলাদা কিছু নেই৷ নীলনদ দেখে অদ্ভুত লাগছিলো৷ একটা নদী, যে নদী এতোদিন শুধু কল্পনাতেই ছিলো - সেই নদী চোখের সামনে৷ পৃথিবীর দীর্ঘতম এই নদী - এই নদীর বুকে গড়ে উঠেছে প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানবসভ্যতা৷ সেই মানুষেরা এমন কাজ করে গেছে যা আমরা আজকের দিনেও করার কথা ভাবতেও পারবো না৷
এতো টায়ার্ড ছিলাম যে ভালো করে খেতেও পারলাম না৷ ঘরে ফিরে আধঘন্টা শুয়েই বেরিয়ে পড়তে হল৷
এবার গন্তব্য কার্নাক টেমপেল কমপ্লেক্স৷ প্রাচীন পৃথিবীর ধর্মস্থানগুলোর মধ্যে বৃহত্তম৷ প্রায় মাইলখানেক ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই মন্দির৷ প্রধান উপাস্য দেবতা আমুন-রা ছাড়াও মুত এবং আরো কিছু দেবতার মন্দির রয়েছে৷ মিশরের প্রায় সব রাজাই এই মন্দির সৃষ্টিতে কনট্রিবিউট করেছেন৷ রামেসিসের আমলে যে অংশ তৈরী হয়েছে সেখানে রামেসিসের দুটো বিশাল মুর্তি আছে৷ তার একটা এখনো প্রায় অবিকৃত৷ মন্দিরের গায়ের হায়রোগ্লিফিক্সও অনেক জায়গাতেই প্রায় অবিকৃত রয়েছে৷ রং প্রায় পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে৷ মাঝে মাঝে সিলিংএর কিছু কিছু জায়গায় রং বোঝা যায় এখনো৷ আমরা তার ছাবি নিয়েছি৷ দুটো ওবেলিস্ক (এক পাথরের তৈরী উঁচু
পিলার) আছে৷ একটা রামেসিসের আমলে তৈরী৷ আরেকটা হাতশেপসুতের আমলে৷ হাতশেপসুতের তৈরী ওবেলিস্কটা রানীর মৃত্যুর পর পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায় যে সেই ওবেলিস্ক হাতশেপসুতের বানানো৷ কিন্তু ভুমিকম্পে সেই পাথরের দেওয়াল ভেঙে পড়ে আর প্রকাশ হয়ে যায় মিশরের সবচেয়ে বিতর্কিত ফারওএর অমর কীর্তি৷ মন্দিরের গর্ভগৃহে যেখানে পুজো হত সেই ঘর মোটমুটি অক্ষত আছে৷ খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার - গর্ভগৃহের দেওয়ালে আলেকজান্ডারের সাথে আমুন-রার ছবি৷ অর্থাত্ গ্রীক আমলেও এই মন্দিরে পুজো হয়েছে৷ আলেকজান্ডার আমুনের মন্দিরে পুজো দিয়ে আরোগ্য কামনা করেছেন৷ গর্ভগৃহের পেছনে বিশাল উঠোন৷ সেখানে পুজোর সময় নাচগান হত - যেগুলো পুজোর রিচুয়ালেরই অঙ্গ ছিল৷কর্নাক মন্দিরের যেটা সবচেয়ে অভিভুত করলো আমাদের তা হল এর বিশালত্ব৷ বিশাল উঁচু উঁচু পিলার৷ তার গায়ে হায়রোগ্লিফিক্স৷ পড়ন্ত সুর্যের আলো এসে পড়েছে ওবেলিস্কের চুড়ায়৷ মনে হচ্ছিল সেই যুগে চলে গেছি৷ আমুন রার পুরোহিতরা এখনি দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারন করতে করতে বেরিয়ে আসবে গর্ভগৃহ থেকে৷
কার্নক টেম্পল দেখার পরেও যে কিছু দেখে ভালো লাগতে পারে তা ভাবি নি৷ ভুল ভাঙলো বাস এসে যখন দাঁড়ালো লুক্সর টেম্পলে৷ তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে৷ লুক্সর টেম্পল আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে৷ অসাধারন লাগছে মন্দিরের প্রবেশপথের দুইপাশে দ্বিতীয় রামেসিসের বিশাল মুর্তিদুটোকে৷ লুক্সরের মন্দির প্রাচীন কালে কর্নাক মন্দিরের সাথে
আড়াই কিলোমিটার লম্বা একটা রাস্তা দিয়ে যুক্ত ছিল৷ সেই রাস্তার দুইপাসে ভেড়ার মাথাওয়ালা স্ফিংক্সের মুর্তির সারি৷ রাস্তার নাম তাই স্ফিংক্স অ্যাভেনিউ৷ কার্নাক মন্দিরে এই স্ফিংক্স অ্যাভেনিউর কিছু অংশ আমরা দেখেছি৷ আরো কিছুটা দেখা গেল লুক্সর মন্দিরের সামনে৷ বাকি স্ফিংক্স অ্যাভেনিউ ঢাকা পড়ে আছে বর্তমান লুক্সর শহরের নিচে৷ এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আরবীতে লুক্সর কথার অর্থ প্যালেস৷ হয়তো এই মন্দিরগুলো দেখেই এমন নাম দেওয়া হয়েছিল৷ লুক্সর মন্দির প্রায় পুরোটাই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বালির নিচে৷ মুসলিম আমলে এই মন্দিরের ওপরে একটা মসজিদ তৈরী হয়৷ সেই মসজিদ এখনো অটুট আছে৷ শুধু তার তলায় খুঁজে পাওয়া গেছে তিনহাজার বছরের পুরোনো পেগান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ৷ লুক্সর মন্দির কার্নাকের থেকে অনেক ছোটো, কিন্তু স্টাইলটা একই রকম৷ সেই রকমই একজোড়া ওবেলিস্ক৷ যার একটা আঠারো শতকে এখান থেকে উপড়ে নিয়ে যাওয়া হয় ফ্রান্সে - প্যারিসের রাস্তার শোভাবৃদ্ধি করতে৷ রয়েছে সেই রকমই উঁচু উঁচু পিলার৷ কিছুদিন আগে এই রকম একটা পিলারের রিকনস্ট্রাকশনের সময় মাটির নিচে পোঁতা কিছু মিশরীয় দেবতার মুর্তি পাওয় গেছে৷ হয়তো রোমান আক্রমনের সময় পুরোহিতরা বিধর্মীর হাত থেকে দেবতাকে বাঁচাতে মাটির তলায় লুকিয়ে রেখেছিল৷ মন্দিরের গর্ভগৃহে কিছু অংশে হায়রোগ্লিফিক্স মুছে ফেলে তার ওপর লাস্ট সাপারের ছবি আঁকা হয়েছে৷ সম্ভবত রোমান আমলে খ্রীষ্টান সন্ন্যাসীদের কীর্তি৷ অদ্ভুত লাগছিল তিনহাজার বছরের পুরনো মিশরীয় মন্দিরে ইসলাম আর খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারকদের সহাবস্থান দেখে৷ ক্লাস টেনে পড়া ঐ কবিতাটার লাইনটা মনে পড়ছিলো বারবার - "মানুষইদেবতা গড়ে, তাহার কৃপার পরে করে দেবমহিমা নির্ভর"!
লুক্সর থেকে জাহাজে ফিরেই ডিনার৷ খুব ভালো ডিনার ছিল৷ ভালো খেয়েছি৷ তারপর টানা ঘুম৷ঘুম ভাঙলো সাড়ে পাঁচটায়৷ শুভ তখন আমায় ডাকছে সানরাইজ দেখতে যাওয়ার জন্য৷ একটা হাল্কা সোয়েটার চাপিয়ে ডেকে উঠে এলাম৷ তখনো আবছা অন্ধকার৷ দুইপাশে ঘুমন্ত মিশর৷ আমরা ভেসে চলেছি নীলনদের ওপর দিয়ে৷ পাঁচহাজার বছরের মিশরীয় সভ্যতার কত উত্থানপতনের সাক্ষী এই নীলনদ৷ আজ আমরাও তার হিসেবের খাতায় ঢুকে গেলাম৷ পুব আকাশ ফরসা হয়ে সোনালী সুর্য মুখ বাড়ালো৷ আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো৷ মনে হল পাঁচহাজার বছরের কল্পনায় গড়ে তোলা সুর্যদেবতা রা আমাদের অভ্যর্থনা করলেন৷ এই পৃথিবীর প্রতিটি ধুলিকণায় মিশে আছে যে অপরিসীম বিস্ময় - সেই বিস্ময়ে বিস্মিত হওয়ার আশীর্বাদ আমরা পেয়ে গেলাম৷
ব্রেকফাস্ট খেয়ে লিখতে বসেছিলাম৷ এখন বেলা গড়িয়ে দুপুর৷ বিকেলে পৌঁছবো এডফুতে৷ সে গল্প পারলে লিখে ফেলবো আজ রাতেই৷
২০ নভেম্বর, বিকেল ৩:৪৫, অসওয়ান এয়ারপোর্ট
অসওয়ান এয়ারপোর্টে বসে আছি৷ কায়রো যাবো৷ কাল সারাদিন কায়রো ঘোরা৷ তারপর মিশরকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফেরা৷ গত দুদিন যে কেমন ভাবে কেটে গেল! সারাদিন নীলনদে ভেসে বেড়ানো৷ মাঝে মাঝে তরী ভিড়ছে তীরে৷ দুহাজার বছরের পুরোনো মানুষের অপুর্ব সৃষ্টি ভেসে উঠছে চোখের সামনে৷ এখানে সবাই দেখছি ভারতীয়দের বেশ পছন্দ করে৷ পরশু সালোয়ার কামিজ পড়েছিলাম৷ সন্ধ্যাবেলা আমাদের বোট এডফু পৌঁছালে আমরা টাঙ্গায় চেপে চললাম হোরাসের মন্দির দেখতে৷ এডফু একেবারে পশিমবঙ্গের সাধারন মফস্বল শহরের মতই৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে, দোকান ঘরের সামনে ছেলেছোকরাদের জটলা৷ আমাদের দেখেই তারা চেঁচিয়ে উঠছে "ইণ্ডিয়া! অমিতাভ বচ্চন! রানী মুখার্জী!!" যা বুঝলাম বলিউডের দেবতারা বেশ ভালই পুজো পান এখানে :)
এডফুর হোরাসের মন্দির দুহাজার বছরের পুরোনো৷ এবং রঙ বাদে প্রায় পুরোটাই অক্ষত৷ হোরাসের গল্প আগেই বলেছি৷ মৃত্যুদেবতা ওসিরিস আর
শুশ্রুষার দেবী আইসিসের ছেলে৷ যে বড়ো হয়ে তার বাবা ওসিরিসের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে কাকা সেথকে মেরে৷ হোরাস তাই মিশরীয়দের কাছে অশুভশক্তিকে হারিয়ে শুভশক্তির জয়ের প্রতীক৷ হোরাস মন্দিরের দেওয়ালে হায়রোগ্লিফিক্সে হোরাসের সেথবধের কাহিনী লেখা৷ আর তার পাশে পাশে সেই কাহিনীর বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি আঁকা৷ মন্দিরটা যেহেতু প্রায় পুরোটাই অক্ষত আছে তাই আমরা প্রাচীন মিশরীয়দের পুজাপদ্ধতির বেশ খানিকটা আন্দাজ পেলাম৷ হিন্দুদের পুজোর সাথে ভীষন মিল৷ আমাদের মতই নৈবেদ্য সাজানোর ঘর, মন্দির প্রাঙ্গন, গর্ভগৃহ৷ গর্ভগৃহে প্রধান পুরোহিত ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারবে না৷ হিন্দুদের মতই ঠকুরকে চান করানো, নতুন পোষাক পরানো, ভোগ দিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ঠাকুরের খাওয়ার অপেক্ষা করা এবং সব শেষে প্রসাদ বিতরন৷ এই সব রিচুয়াল অবশ্য সবই লোপ পেয়েছে দুহাজার বছর আগে৷ মন্দিরের হায়রোগ্লিফিক্সে আর পুজাপদ্ধতির অজস্র ছবিতে প্রমান রয়ে গেছে৷ মন্দিরের গর্ভগৃহে একটা ভীষন সুন্দর কাঠের নৌকা রয়েছে৷ মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল এই নৌকা চেপে হোরাস তার কাকা সেথকে বধ করেন৷ এই নৌকা তাই পবিত্র৷ দুহাজার বছরের পুরোনো নৌকার গঠন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম৷
সেদিন আমাদের ক্রুজে ইজিপশিয়ান ডিনার ছিল৷ দুর্দান্ত খেলাম৷ কালোজিরে দেওয়া একরকম রুটি - অনেকটা আমাদের খাস্তা নিমকির মত৷
তারপর বেগুন ভেজে তার সাথে পেয়াজ দিয়ে একটা ঠান্ডা স্যালাড বানিয়েছিল৷ সেটাও দারুন৷ ওদের বিফের প্রিপারেশন তো ভালো বটেই৷ মাছটাও খুব ভালো বানিয়েছিল৷ বাবা গানুজ ছিল৷ সাদা তিল বেটে একটা সস বানিয়েছিল৷ সেটাও খুব ভালো খেলাম৷ সব শেষে প্রান ভরে বাকলাভা খেয়েছি :)
ওহো - বলতে ভুলে গেছি৷ দুপুরে বোট যখন লকগেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তখন দেখি একগাদা ছোটো ছোটো নৌকা আমাদের ছেঁকে ধরেছে৷ ঐ নৌকাগুলো আসলে ছোটো ছোটো দোকান৷ দোকানীরা নৌকো থেকে আমাদের ডেকে ছুঁড়ে দিচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা গালাবা আর জিলাবিয়া৷ গালাবা আর জিলাবিয়া হল ট্র্যাডিশনাল মিশরীয় পোষাক৷ ছেলেদের গালাবা আর মেয়েদের জিলাবিয়া৷ দুটো ই পা পর্যন্ত লম্বা আলখল্লা টাইপের পোষাক৷ রাতে আমাদের ক্রুজে ইজিপসিয়ান নাইট ছিল৷ তাই অনেকেকেই কিনে নিল পার্টির পোষাক৷ আমিও আমার কেবিনের জানলা দিয়ে কিনে নিলাম একটা শাল৷ নৌকা থেকে প্লাস্টিকে ভরে আমায় শাল ছুঁড়ে দিল৷ প্রথমে চাইলো দুশো ইজিপশিয়ান পাউন্ড৷ শুভ সেটাকে দরাদরি করে পঞ্চাশে নামিয়ে আনলো৷ প্লাস্টিকে ভরে টাকা ছুঁড়ে দিলাম নৌকায়৷
কাল সারা সকাল সেলিং৷ সাড়ে এগারোটা নাগাদ কেবিনের জানলা দিয়ে দেখি নীলনদের কোলে ভেসে উঠছে এক অপুর্ব স্থাপত্য৷ যেন টুকরো টুকরো কল্পনা জুড়ে পিছিয়ে গেলাম দুহাজার বছর৷ তরী ভিড়লো কম-অম্বোতে কুমিরের মুখওয়ালা দেবতা সোবেকের মন্দিরে৷ এই মন্দির আসলে একজন নয় - দুই দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত - হোরাস আর সোবেক৷ হোরাসের মা হল শুশ্রুষার দেবী আইসিস৷ এই মন্দির তাই একসময় হাসপাতাল হিসেবেও ব্যবহার হয়েছে৷ মন্দিরের পেছনের দেওয়ালে বিভিন্ন সার্জিকাল ইনস্ট্রুমেন্টসের ছবি৷ তার পাশে দুই মহিলার ছবি যাদের একজন সন্তানের জন্ম দেবে, আরেকজন সন্তানের জন্ম দিয়েছে৷ হোরাসের সাথে এখানে আরো আছে হোরাসের স্ত্রী হেথারের ছবি৷ হেথারও মাতৃত্ব আর মমতার দেবী৷
মিশরের আরো অনেক মন্দিরের মত এই মন্দিরের দেওয়ালেও লোটাস, প্যাপিরাস, বিভিন্ন শস্যের ছবি আঁকা৷ তার এক পাশে রাজার, আরেকপাশে দেবতার ছবি৷ রাজা এই সব কিছু দেবতাকে নিবেদন করবেন৷ ভিভিয়ান আমাদের নিয়ে গেল এক জায়গায় যেখানে হায়রোগ্লিফিক্সে প্রাচীন মিশরীয় ক্যালেন্ডার খোদাই করা আছে৷ বছরের প্রতিটা দিন খোদাই করা আর তার পাশে সেই দিনে দেবতাকে কি নৈবেদ্য দেওয়া হবে তার ছবি৷ আরেকটি দেওয়ালের একাংশে শুধু দুটো চোখ আর কান আঁকা আছে৷ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সব শুনছেন, সব দেখছেন৷

কম-অম্বোর এই মন্দিরের গর্ভগৃহ দুটি৷ একটা সোবেকের জন্য৷ আরেকটা হোরাসের জন্য৷ দুই গর্ভগৃহের মধ্যে যে দেওয়াল তার ভেতরটা ফাঁপা৷ সেখানে নেমে গেছে একটা সুড়ঙ্গ৷ রাজা যাখন মন্দিরে প্রার্থনা করতে আসতেন প্রধান পুরোহিত তখন নেমে যেতেন ঐ সুড়ঙ্গে৷ রাজা দেবতার সাথে কথা বলতেন৷ দেবতার হয়ে উত্তর দিতেন পুরোহিত৷ রাজা এই চালাকিটা ধরতে পারলেও তাঁর কিছু করার ছিল না৷ এতো জানাই আছে ধর্মের আফিম রাজার তলোয়ারের চেয়েও শক্তিশালী৷
হোরাসের মন্দিরে বেশ কিছু জায়গায় রঙ এখনো মুছে যায়নি৷ দুহাজার বছরের রোদ-জল উপেক্ষা করে এখনো ঝলমল করছে৷ আমরা যখন গেছিলাম তখন ওখানে আমরা ছাড়া আর কেউ ছিল না৷ নীলনদের হাওয়া দুহাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসের গন্ধ বয়ে আনছিল৷ প্রায় ফাঁকা মন্দিরে আমরা দুজনে অনেকক্ষন ঘুরে বেড়ালাম৷ একটা ঘুপচি ঘরে স্টেথোস্কোপ কানে দেওয়া এক ডাক্তারের ছবি পাওয়া গেল৷ তার পাশে ঐ রকমই একটা অন্ধকার ঘরে এক রানীর ছবি দেখিয়ে স্থানীয় এক মানুষ বললো ক্লিওপেট্রা৷ সত্যি করেই ক্লিওপেট্র কিনা জানি না, তবে লোকটা দুই ডলার বখশিশ আদায় না করে পিছু ছাড়লো না৷ আমরাও বোটে ফিরে এলাম৷ ভেসে চললাম অসওয়ানের দিকে৷
২২ নভেম্বর, দুপুর ১২:৩৮, ফেরার বিমানে অ্যাটলান্টিকের ওপর
আজ ফিরছি৷ খানিক পরেই নিউ ইয়র্ক পৌঁছাবো৷ সাত দিনের এই মিশর ভ্রমনে মন এমন কানায় কানায় ভরে আছে যে ঘরে ফিরে কাজে মন দেওয়া মুশকিল হবে৷ ১৯ তারিখের রাতে অসওয়ান পৌঁছলাম৷ রাতে ভিভিয়ান আমাদের অসওয়ানের বিখ্যাত স্পাইস মার্কেটে নিয়ে গেল৷ মশলার গন্ধে ম ম করছে৷ আমি অবশ্য মশলা কিনিনি৷ কিছু প্যাপিরাস কিনলাম৷ এখানে বাজারে ভীষন দরদাম করতে হয়৷ ওরা যা চাইবে তার ১/৬ দিয়ে শুরু করা দস্তুর৷ আমাদের সঙ্গী আমেরিকানরা এসব দেখে ভ্যবাচ্যাকা৷ আমরা কয়েকজনের হয়ে বার্গেন করে দিলাম৷ অসওয়ানই আমাদের ক্রুসের গন্তব্য ছিল৷ ২০ সকালে ক্রুসে চেক আউট৷ তারপর সারাদিন অসোয়ান সাইট সিয়িং৷ বিকেলের প্লেনে কায়রো ফেরা৷
২০ সকালে প্রথমে খনিক ঘুরে বেড়ালাম ট্র্যাডিশনাল মিশরীয় নৌকা ফেলুকাতে চেপে৷ এই প্রথম নীলনদের জল স্পর্শ করলাম৷ নৌকাতেও মাঝিটি নানান জিনিসের পশরা সাজিয়ে বসেছে৷ উটের হাড়ের একটা পেপার কাটার আমার খুব পছন্দ হল৷ দাম জিজ্ঞেস করাতে সে বলে টু ফর ফোর, থী ফর ফাইভ৷ আমি বললাম থী ফর টু৷ আমার সহযাত্রীরা খুব হাসলো৷ মাঝিটি তো রেগেমেগে আমার দিকে পেছন ফিরে বসলো৷ পরে অবশ্য নৌকা থামার পর আমার দামেই দিল আমায় :) নৌকা থেকে দেখলাম একটা অদ্ভুত দ্বীপ৷ দুর থেকে মনে হচ্ছে এক পাল হাতি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এর নাম এলিফ্যানটাইন আইল্যান্ড৷ নৌকা ভেসে চললো তার পাশ দিয়ে৷ দেখলাম সেই হোটেল যার একটা সুটে বসে আগথ ক্রিস্টি "ডেথ অন রিভার নাইল" লিখেছিলেন৷ প্রান ভরে নীলনদের হাওয়ার শ্বাস নিলাম৷ ঘন্টাখানেক পর ফিরে এলাম ঘাটে৷ সেখান থেকে আমাদের বাস ছাড়লো অসওয়ান সাইট সিয়িং করাতে৷
প্রথমে গেলাম আনফিনিশড ওবেলিস্ক দেখতে৷ আগে বলেছি বোধহয় ওবেলিস্ক হল এক পাথরের তৈরী উঁচু পিলার যার গায়ে রাজারা তাদের কীর্তির কথা লিখে রাখতো৷ আমরা যেটা দেখতে গেলাম সেই ওবেলিস্কটা অসওয়ানের গ্র্যানাইট কোয়ারীতে তৈরী হচ্ছিল৷ তারপর পাথরটাতে কোনভাবে চিড় ধরে৷ ওবেলিস্ক যেহেতু এক পাথরের হতেই হবে, সেহেতু এই ওবেলিস্কটি পরিত্যক্ত হয়৷ এটা এখনো সেভাবেই পড়ে অছে যেভাবে কয়েক হাজার বছর আগের শ্রমিকেরা এটাকে ফেলে গেছিল৷ অসাধারন দৃশ্য৷ জাস্ট অসাধারন৷ তিনটে পিঠ মসৃন ভাবে কাটা৷ চতুর্থ পিঠ মাটির সাথে এখনো জুড়ে রয়েছে৷ অবাক করলো গ্র্যানাইটের গায়ে পাথর কাটার দাগ৷ কিছুতেই বিশ্বাস হয়না এটা মানুষ হাতে কেটেছে৷ মেশিনের দাঁতের মত আয়তাকার দাগ পাথরের ওপর৷ এ জিনিস দেখার পর দানিকেনের থিয়োরী বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়৷
পরের গন্তব্য ছিল ফিলি দ্বিপে আইসিসের মন্দির৷ এটা মিশরের শেষ পেগান মন্দির৷ খ্রীষ্টিয় ষষ্ঠ শতকে এই মন্দিরে শেষ পুজা হয়েছে৷ তারপরে খ্রীষ্টানদের দখলে চলে যায়৷ অসওয়ান লেকের ওপর এই মন্দির অপুর্ব সুন্দর৷ এটাকে সাধারনভবে ফিলির আইসিস মন্দির বলে রেফার করা হলেও বর্তমানে মন্দিরটি ফিলি দ্বীপে নেই৷ ষাটের দশকে অসওয়ান হাই ড্যাম তৈরী হওয়ার পর জলতল বেড়ে ফিলি দ্বীপ জলের তলায় ডুবে যায়৷ তখন পুরো মন্দিরটাকে ছোটো ছোটো টুকরো করে আরেকটি অপেক্ষাকৃত উঁচু দ্বীপে তুলে এনে টুকরোগুলি জোড়া লাগানো হয়৷ নীল অসওয়ান লেকের বুকে ছোট্টো সবুজ দ্বীপটি জেগে আছে৷ তার বুকে আইসিসের মন্দির৷ স্থাপত্য এখনো অনেকটাই অবিকৃত৷
মন্দিরের দেওয়ালের ছবি থেকে দেবতার মুখ খুবলে নেওয়া হয়েছে৷ খ্রীষ্টধর্ম প্রসারের সময় যারা বাধ্য হয়েছিল ধর্মান্তরিত হতে, অথচ মনে মনে বিশ্বাস করতো মুর্তিপুজাতেই - তারা হয়তো ভয় পেয়েছিল দেবতার রোষের৷ তাই বিকৃত করে দিয়েছিল মুর্তির মুখ৷ ভেবেছিল মুখ বিকৃত করে দিলে হয়তো দেবতা আর দেখতে পাবেন না তাদের৷ আরেকটা ইন্টারেস্টিং তথ্য বলে নিই এই ফাঁকে৷ প্রাচীন পেগান সভ্যতাগুলোর মত মিশরীয়রাও বিশ্বাস করতো সিমেট্রিতে৷ তাই মিশরীয় মন্দিরগুলো বামদিকটা অনেকসময়ই ডানদিকের মিরর ইমেজ৷ অনেক মন্দিরের ধ্বংসস্তুপে তাই দেখেছি শুধু বামদিকটা বা শুধু ডানদিকটা বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে৷ একদিকটা নষ্ট করে দিলেই সিমেট্রি নষ্ট হয়ে গেল৷ আর সেই সাথে নষ্ট হয়ে গেল সংশ্লিষ্ট দেবতার শক্তিও - এই রকমই বিশ্বাস৷
আইসিসের মন্দিরের দেওয়ালে দেখেছি ল্যাটিন-কোপটিকে লেখা অজস্ব গ্রাফিতি৷ বেশকয়েকটা পিলারে পুরোনো ছবিকে মুছে দিয়ে খোদাই করা আছে ক্রশ৷ তবে সেই ক্রশ কিন্তু আমরা এখন যে ক্রশ দেখি সেই রকম নয়৷ সিমেট্রিক ক্রশ৷ চারটে বাহুই সমান, একইরকম৷ বুঝতে পারছিলাম যুগপরিবর্তনের এক সন্ধিক্ষনের সাক্ষী হয়েছি৷ এই প্রসঙ্গে একটা নিজস্ব অবসারভেশনের কথা লিখে আইসিস মন্দিরের গল্প শেষ করি৷ প্রায় সব মিশরীয় দেবতাই হাতে একটা বিশেষ চিহ্ন ধরে আছেন দেখলাম৷ এর নাম ankh ৷ এই চিহ্নের অর্থ হল iternal life ৷ এখন আমরা যে ক্রশ চিহ্ন দেখি তার সাথে ankh এর ভীষন মিল৷ আমাদের গ্রুপের একটি মেয়ে ankh পরেছিল গলায় লকেট করে৷ আমি প্রথমে সেটাকে ক্রশ ভেবেছিলাম৷ আমাদের গাইড ankh এর দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করার পর বুঝলাম মেয়েটি ankh পরেছে৷ ankh এর ওপরের অংশ একটা চোখের মত৷ বাকি অংশ সাধরন ক্রশের মত অ্যাসিমেট্রিক৷
এর পর আর বিশেষ কিছু দেখার ছিল না সেদিন৷ পথে অসওয়ান হাই ড্যামে বাস থামলো একবার৷ বিশাল এই ড্যামের পাশেই মানুষের তৈরী পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো জলশয় লেক নাসের৷ মিশরের রুক্ষ দক্ষিনপ্রান্তে এই জলাশয় মিশরের বর্তমান অর্থনীতিতে অসামন্য গুরুত্বপুর্ন হলেও প্রাচীন মিশরের নেশায় এমন বুঁদ হয়েছিলাম যে এই লেকটির দিকে বিশেষ মন দিতে পারলাম না৷ বাস চললো এয়ারপোর্টে৷ পড়ন্ত বিকেলের আলোয় রুক্ষ ধুষর অসওয়ানকে বিদায় জানিয়ে আমরা উড়ে চললাম কায়রোর দিকে৷
২৬ নভেম্বর, ব্যাটেলক্রিক, সকাল ৯:৩৭
মিশর থেকে ফিরেছি তিনদিন হয়ে গেল৷ আসার পর থেকেই সেমেস্টার শেষের চাপ আর বাড়ী ফেরার অপরিসীম আলস্য যেভাবে একসাথে সাঁড়াশী আক্রমন চালিয়েছিল যে ভাবছিলাম আমার আরো পাঁচটা কাজের মত এই মিশর ডায়েরীও অসমাপ্ত রয়ে যাবে বুঝি৷ আজ অফিসে এসে দেখি কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ রেসপন্ড করছে না৷ কাজকর্ম শিকেয় তুলে তাই মিস্তিরীর অপেক্ষায় বসে আছি৷ আর সেই অবসরে চলছে ডায়েরী লেখা৷
২১ তারিখ সকালটা ছিল পিরামিড আর স্ফিংক্সের জন্য৷ ভোরে ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে দেখি হোটেলের লবি থেকে পিরামিড দেখা যাচ্ছে৷ ব্রেকফাস্ট খাওয়া মাথায় উঠলো৷ ছবি তুলতে ছুটলাম৷ তারপর সত্যিই যখন বাসে চেপে বসলাম আর আমাদের গাইড জানালো আমরা এখন চলেছি গিজাতে
যেখানে ইচ্ছা করলে পিরামিডের ভেতরেও আমরা ঢুকতে পারি তখন মনে হচ্ছিল আমার হার্টবিটের শব্দ বুঝি বাসের ড্রাইভারও শুনতে পাচ্ছে৷ গিজার সবচেয়ে বড়ো পিরামিড যেটাকে আমরা খুফুর পিরামিড বলে জানি সেটার ভেতরে ঢোকার দক্ষিনা ১০০ ইজিপসিয়ান পাউন্ড৷ আর তার পাশের পিরামিডটি যেটা খুফুর পিরামিডের থেকে সামান্যই ছোটো - সেই খেফরনের পিরামিডে ঢুলতে লাগে মাত্র ২৫ ইজিপসিয়ান পাউন্ড৷ সঙ্গত কারনেই তাই ঠিক হল আমরা খেফরনের পিরামিডের ঢুকবো৷ খেফরনের পিরামিডের চূড়ার কাছে অরিজিনাল লাইমস্টোনে কেসিং এখনো রয়ে গেছে৷ একসময় প্রতিটা পিরামিডের গায়েই মসৃন লাইমস্টোনের আস্তরন ছিল৷ সূর্যের আলো পড়ে দিনের বেলা সেটা ঝলমল করতো৷ ভুমিকম্পে এই আস্তরন ভেঙে যায়৷ এখন তাই সবকটা পিরামিডের অমসৃন এবড়ো খেবড়ো বহিরাবরনটুকুই আমরা দেখতে পাই৷ শুধুমাত্র খেফরনের পিরামিডের চূড়াতে কিছু অংশে এখনো ঐ লাইমস্টোনের আস্তরনটি রয়ে গেছে৷ তবে এখন আর সেটা সুর্যের আলো পড়ে ঝলমল করে না৷
পিরামিডের সামনে একটা ছোটো কি-অস্কে টিকিট বিক্রি হচ্চে৷ টিকিট কিনে আমরা লাইনে দাঁড়ালাম৷ ভিভিয়ান আমাদের আগেই সাবধান করে দিয়েছিল পিরামিডে ঢোকার পথ একটা ছোটো সুড়ঙ্গের মত৷ পাশাপাশি বড়জোর দুজন চলতে পারে৷ ছাদ এতো নিচু যে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে হবে৷ ভেতরে কোন ভেন্টিলেশন নেই৷ তাই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে পারে৷ ভিভিয়ানের কথা একান দিয়ে ঢুকে ওকান দিয়ে বেরিয়ে গেছে৷ মিশরে এসে সুযোগ পেয়েও পিরামিডে ঢুকবো এ আবার হয় নাকি৷ আর গাইডেরা অনেক সময়েই বাড়িয়ে বলে৷ সেবারে ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে রাইড নেওয়ার সময়েও অনেকে সাবধান করেছিল৷ কিছুই তো হয়নি৷ ভিভিয়ান যে ফাঁকা বুলি আওড়ায়নি সেটা বুঝলাম একটু পরেই৷ বড়োজোর তিনফুট চওড়া সুড়ঙ্গের একদিক দিয়ে মানুষ ঢুকছে, অন্যদিক দিয়ে বেরোচ্ছে৷ সুড়ঙ্গটি আবার সোজা নয়, সেটা বেঁকে গেছে নিচের দিকে৷ দেওয়ালে খানিক দুরে দুরে আলো লাগানো আছে বটে, কিন্তু মোটের ওপর জায়গাটা অন্ধকার৷ এতো লোকের আনাগোনায় একটা ভ্যপসা বাষ্প তৈরী হয়েছে যেটা আমায় ক্লস্টোফোবিক করে তুলছিল৷ পিঠ বেঁকিয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সুড়ঙ্গ দিয়ে নামতে নামতে মনে হচ্ছিল এ পথের বুঝি আর শেষ নেই৷ অথচ সত্যি করে হয়তো বড়োজোর তিনমিনিট হেঁটেছি৷ সুড়ঙ্গ একসময় একটা ছোটো সমতল কুঠুরীতে এসে শেষ হল৷ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম৷ এখানে পাথরের দেওয়ালের গায়ে একটা ছোটো কুলুঙ্গীর মত৷ আর আমাদের ডানদিকে আরেকটা সুড়ঙ্গ অন্য একটা ঘরে চলে গেছে৷ সেটার দরজা বন্ধ৷ আন্দাজে মনে হল এটা রানীর সমাধি৷ কারন শুনেছিলাম রানীর সমাধিকক্ষটি বেশ ছোটো এবং সেটা বন্ধ আছে৷ কুঠুরী থেকে আরেকটা সুড়ঙ্গ এবার চলে গেছে ওপরের দিকে৷ সেই সুড়ঙ্গ ধরে চলতে শুরু করলাম৷ দেখলাম পিঠ বেঁকিয়ে ওপরের দিকে ওঠা অপেক্ষাকৃত সোজা৷ এবার কম কষ্ট হল৷ সুড়ঙ্গ শেষ হয়েছে একটা মাঝারী আকারের ঘরে৷ সেখানে একটা পাথরের সার্কোফেগাস (কফিন) রাখা৷ ব্যাস৷ আর কিছু নেই৷ চারহাজার বছর অগে হয়তো এই ঘরটিকে সোনাদানায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল৷ হয়তো সমাধিকক্ষে, সুড়ঙ্গের দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছিল ওসিরিসের সভায় শেষ বিচারের ছবি৷ এখন আর সেসবের কিছুই নেই৷ কালো পাথরের সার্কোফেগাসটার কাছে গিয়ে খানিকক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ভ্যপসা সুড়ঙ্গপথ৷ তার শেষে এই অপ্রশস্ত প্রায়ন্ধকার সমাধিকক্ষ৷ মনে হচ্ছিল সত্যিই অন্য এক দুনিয়াতে চলে এসেছি৷ অতো লোকের মাঝেও গা ছমছম করছিল৷ হতে পারে মুক্ত বাতাসের অভাবে৷ হতে পারে এতোক্ষন কুঁজো হয়ে হাঁটার জন্য৷ হতে পারে এতোদিনের পড়া গল্প আর সত্যিকরে পিরামিডের ভেতরে পা ফেলার অভিজ্ঞতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল বলে৷ শেষবারের মত ফারাও খেফরনের গোপনতম ঠিকানায় চোখ বুলিয়ে ফেরার পথ ধরলাম৷ আবার সেই বদ্ধ সুড়ঙ্গ৷ কতক্ষনে সুর্যের আলো দেখবো সেই আশায় হামাগুড়ি দিয়ে পথ চলা৷
পিরামিড থেকে ঘুরে আসার পাঁচ দিন পর এই লেখা লিখছি৷ এখনো ঘোর কাটেনি আমার৷ লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স কাকে বলে তা প্রথম বুঝেছিলাম ১৯৯৫ সালের অক্টোবর মাসে যখন পুর্ণ সুর্যগ্রহনের চুড়ান্ত মুহুর্তটিতে আকাশ-বাতাস এক অপার্থিব নীলাভ দ্যুতিতে ঢেকে গেছিল৷ আবার বুঝলাম ২০০৭ এর ২১শে নভেম্বর পিরামিডের মধ্যে পা রেখে৷ এ এমন এক বিস্ময়কর অনুভুতি যা লিখে প্রকাশ করবো এমন ভাষা আমার জানা নেই৷ দুটো ই যেন এক অন্য পৃথিবী থেকে ঘুরে আসা৷ এক চুড়ান্ত বিস্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে যাওয়া৷
অনেক প্রশ্ন ছিল মনে৷ কিছুই জিজ্ঞাসা করা হলনা ভিভিয়ানকে৷ এখন মনে হচ্ছে জানতে পারলে ভালো হত মিশরে সহমরন ছিল কিনা৷ রানীকে কি তার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর পিরামিডে নিয়ে গিয়ে সমাধি দেওয়া হত, নাকি কোন বিভত্স প্রথা জড়িয়ে ছিল এর সাথে যা ভাবতে গেলেও এখন আমার হাড় হিম হয়ে আসছে৷ প্রশ্ন জাগছে ঐ সুড়ঙ্গ আর সমাধিকক্ষটুকু বাদ দিলে বাকি পিরামিডটা কি ফাঁপা? কিছুই জেনে নেওয়া হয়নি৷ ঐ সরু সুড়ঙ্গের ওপারের মৃত্যুপুরী আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল৷ পিরামিড থেকে বেরোনোর পর ভিভিয়ান আমাদের নিয়ে এলো আরেকটা স্পটে যেখান থেকে স্ফিংক্সকে দেখা যায়৷
স্ফিংক্স এক বিশাল পাথরের সিংহ যার মুখটা মানুষের৷ মিশরের ইতিহাস দাবী করে এই মুখ ফারাও খেফরনের৷ আজকের ঐতিহাসিকরা অন্য কথা বলেন৷ তাঁরা বলেন এ আসলে কোন পুরুষের মুখই নয়৷ এই মুখ এক আফ্রিকান নারীর৷ এই মুখ খোদাই হয়েছে ফারাওদেরও আগের যুগে৷ তারপর আর সব তথাকথিত উন্নত সভ্যতার মতই মিশরীয় সভ্যতাও আদিবাসীদের এই কীর্তিকে নিজেদের বলে চালিয়েছে৷ ফিংক্সের নাকটা ভাঙা৷ ভাঙা নাকে অনেক পায়রা বাসা বেঁধে আছে :) স্ফিংক্সকে আরো কাছ থেকে দেখতে হলে খেফরনের ভ্যালি টেম্পলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে৷ ভ্যালি টেম্পল হল সেই যায়গা যেখানে মমি তৈরী হত৷ প্রত্যেক পিরামিডের সাথেই একটি সংলগ্ন ভ্যালি টেম্পল আছে৷ এখানেই মস্তিষ্ক, পাকস্থলি, অন্ত্র আর ফুসফুস মৃতের শরীর থেকে বার করে চারটি আলাদা পাত্রে ভরে মমি করে মৃতের কফিনের সাথে দিয়ে দেওয়া হত৷ বাকি শরীরটা নুন আর আরো বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হত চল্লিশ দিন৷ কি সেই রাসায়নিক যা তিনহাজার বছর ধরে একটা দেহকে টিকিয়ে রাখতে পারে তা আজকের বিজ্ঞান এখনো জানে না৷ তারপর লিনেনে জড়ানো হত সেই দেহ৷ হাতের আঙুল, কনুইএর মত ভঙ্গুর অংশ মুড়ে দেওয়া হত সোনার পাতে৷ তারপর সেই মমি ঢুকতো কফিনে৷ হয়তো সোনার কফিনে৷ যার একমাত্র নিদর্শন আমরা দেখেছি তুতানখামুনের সমাধিতে৷ বাকি সবকটি আবিষ্কৃত সমাধি গবেষনার সুযোগ পাওয়ার আগেই লুঠ হয়ে গেছে৷ তবে তুতানখামুনের মত নগন্য কিশোরের সমাধিতে যদি ঐ অতুলনীয় সম্পদ পাওয়া গিয়ে থাকে তাহলে খুফুর মত ফারাও যিনি কম করে ২০ বছর রাজত্ব করেছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো পিরামিড বানিয়েছেন - তার সমাধিতে কত সোনাদানা দেওয়া হয়েছিল তা আমাদের চিন্তারও বাইরে৷
স্ফিংক্সের কথায় ফিরে আসি৷ ভ্যালি টেম্পলের পেছনের একটা দরজা দিয়ে বেরোতেই স্ফিংক্স একেবারে চোখের সামনে চলে এলো৷ স্ফিংক্স যে কত বিশাল তা এতোক্ষনে বুঝতে পারলাম৷ আর আরো অবাক করে দেওয়া ঘটনা হল এই বিশাল স্ফিংক্স কিন্তু পিরামিডের তুলনায় বেশ ছোটো৷ তিনটে পিরামিড আর স্ফিংক্স সহ সাহারার এই প্রান্ত এতো বিশাল যে আমাদের এতোদিনের বিশালত্বের ধারনা ওলটপালট হয়ে যায়৷ নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং বা শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার আমার মনে এই বিস্ময়ের জন্ম দেয়নি যদিও এই দুটো ই পিরামিডগুলোর চেয়ে অনেক উঁচু৷ রুক্ষ সাহারার বুকে সাড়ে চারহাজার বছরের পুরোনো মানুষের কীর্তিস্তম্ভ আমার মধ্যবিত্ত ধ্যানধারনায় সজোরে ধাক্কা মারে৷ আমার ঘোর কাটে না৷
২৭ নভেমবর, কালামাজু, রাত ৯:৪২
মিশরের গল্প প্রায় শেষ হয়ে এলো৷ গিজা থেকে ফেরার পথে ভিভিয়ান আমাদের নিয়ে গেল একটা এসেন্স শপে৷ বাহারী কাঁচের আতরদানীতে ভরা সেই দোকান যেন আরব্য উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে৷ সুদৃশ্য পেয়ালায় টার্কিশ কফিতে আমাদের আপ্যায়িত করে দোকানদার আমাদের এক হারিয়ে যাওয়া সুগন্ধির গল্প শোনাতে বসলো৷ লোটাস ছিল প্রাচীন মিশরের আদরের ফুল৷ প্রায় সব মন্দিরেই তাই আমরা লোটাস আর প্যাপিরাসের ভাস্কর্য দেখেছি৷ কিন্তু পেগান সভ্যতার অবসানের সাথে সাথে প্রাচীন মিশরের এই সম্পদটিও চিরতরে হারিয়ে গেছিল৷ বিশ শতকে হাওয়ার্ড কার্টার যখন তুতানখামুনের সমাধি প্রায় অবিকৃত অবস্থায় খুঁজে পেলেন তখন আর সব জিনিসের সাথে তিনি পেলেন কিছু অ্যালবেস্টার ভাস৷ সেই ভাসের মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য সুগন্ধি যার সুবাস তিনহাজার বছর পরেও অম্লান৷ শুধু গন্ধই নয়, অ্যালবাস্টার ভাসে পাওয়া গেল তিনহাজার বছরের পুরোনো পদ্ম আর প্যাপিরাসের বীজ৷ সেই বীজ থেকে হারিয়ে যাওয়া সুগন্ধি আবার ফিরে এলো মিশরে৷ এই বলে সে আমাদের মনিবন্ধে এক ফোঁটা করে লোটাস এসেন্স লাগিয়ে দিল৷ অপুর্ব মাদকতাময় সেই গন্ধ রাত পর্যন্ত আমার হাতে ছিল৷ আমার শ্বাশুড়ি মা সুগন্ধি ভালোবাসেন৷ তাঁর জন্য লোটাস নিলাম এক শিশি৷ আমার বরটিও ওমর শরীফ নামের একটি সুগন্ধি কিনলো৷ এর পেছনে কোন খানদানী গল্প না থকলেও গন্ধটি বড় মনোরম৷
দুপুর হয়ে গেছিল৷ প্রচুর গাছপালায় ঘেরা বাগানবাড়ির মত একটি রেস্টোরান্টে ভিভিয়ান আমাদের লাঞ্চ খাওয়াতে নিয়ে গেল৷ প্রথমেই এলো আলু কাবলির মত একটি চাট, ছোটো ছোটো ফুলো ফুলো রুটি, হামাস আর বিট দিয়ে বানানো একটা দারুন স্যালাড৷ সেটা শেষ হতে না হতেই চলে এলো মিটবল৷ দুর্ধর্ষ খেতে৷ অবিকল পাড়ার মোড়ের মাংসের চপের মত৷ আমরা দুই পেটুক আরো চেয়ে নিলাম৷ তারপরে চিকেন রোস্ট ছিল৷ কিন্তু মিটবলটা এতো ভালো লেগেছিল যে চিকেনের দিকে বেশি মন দিতে ইচ্ছা করলো না৷ সব শেষে কফি৷
খেতে খেতে দুটো বেজে গেছিল৷ কায়রো মিউজিয়াম বন্ধ হবে পাঁচটায়৷ আমরা তাই ছুটলাম মিউজিয়ামের দিকে৷ সেই ফাঁকে কায়রো শহরও দেখা হল খানিকটা দিনের আলোতে৷ কারয়োতে বেশির ভাগ বাড়িই দেখি অসমাপ্ত৷ প্রায় কোনো বাড়িরই প্লাস্টার নেই৷ ইঁটের কাঠামোর ওপর নতুন রঙ করা জানলার গ্রিল কদর্য ভাবে শোভা পাচ্ছে৷ ভিভিয়ান আমাদের বললো এখানে বেশির ভাগ মানুষই বাড়ি শেষ করেনা৷ কারন বাড়ি শেষ হলেই প্রপার্টি ট্যাক্স দিতে হবে৷ বাইরে থেকে যে বাড়িগুলোকে ইঁটের কঙ্কাল মনে হচ্ছে সেগুলোর ভেতরের ছবিটা একেবারেই অন্যরকম৷ মিউজিয়াম যাওয়ার রাস্তায় বেশ কিছুটা জায়গা খুঁড়ে ফ্লাইওভার বানানো হচ্ছে৷ আমার গড়িয়াহাটের কথা মনে পড়ে গেল৷ প্রচুর ট্র্যাফিক৷ এর মধ্যেই কারো কারোর সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনোর চেষ্টা৷ কলকাতার মতই অবস্থা৷ তবে কায়রোতে পাবলিক ট্রানস্পোর্ট খুব বেশি চোখে পড়লো না৷ বাস আছে৷ ট্রামও দেখেছিলাম ১৬ তারিখ রাতে৷ কিন্তু সংখ্যায় খুব বেশি নয়৷
অবশেষে আমরা যখন মিউজিয়ামে এসে পৌঁছালাম তখন সাড়ে তিনটে বেজে গেছে৷ টিকিট কেটেই সবার আগে ছুটলাম তুতানখামুনের কালেকশন দেখার জন্য৷ আগে বলা হয়নি, তাই এই সুযোগে তুতানখামুনের কথা আরেকটু বলে নিই৷ তুতানখামুনের আসল নাম তুত-আনখ-আতুম৷ তুতানখামুনের বাবা আখেন-আতুম পৌত্তলিকতার অসারতা উপলব্ধি করে একেশ্বরবাদের প্রবর্তন করেন৷ সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নাম তিনি দেন আতুম এবং সেই নামটি নিজের ও ছেলের নামের সাথে জুড়ে নেন৷ স্বাভাবিক কারনেই মিশরের পুরোহিততন্ত্রের এই পরিবর্তন পছন্দ হয়নি৷ আখেন-আতুমের মৃত্যুর পর তার কিশোর পুত্র তুত-আনখ-আতুম ফারাও হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পুরোহিততন্ত্র সফল হল তাদের পুরোনো দেবতা আমুনকে ফিরিয়ে আনতে৷ তখন থেকে তুত-আনখ-আতুমও তাঁর পুরোনো নাম পরিবর্তন করে তুত-আনখ-আমুন নামে পরিচিত হলেন৷
এবার ফিরে আসি কায়রো মিউজিয়ামে রাখা তুতানখামুনের সমাধির অতুলনীয় সম্পদের কথায়৷ ভ্যালি অফ কিংসে তুতানখামুনের সমাধিতে ঢুকেছিলাম ১৭ তারিখ৷ তারপর কায়রো মিউজিয়ামে সেই সমাধিতে যা যা পাওয়া গেছিল সেগুলো দেখলাম৷ এখনো পর্যন্ত ভেবে চলেছি ঐটুকু জায়গা যদি এতো জিনিসে ভরিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে অন্য সব নামকরা ফারাওদের অপেক্ষাকৃত বড় সমাধিগুলোতে না জানি কত সম্পদ ছিল৷ সব কিছুর বর্ণনা দেওয়া এখানে সম্ভব হবে না৷ যেগুলো প্রথম ঝটকায় মনে আসছে সেগুলো লিখি৷ প্রথমেই মনে পড়ছে দুই প্রহরীর কথা৷ ব্ল্যাক রেজিনে
তাদের গা পালিশ করা৷ পোষাক আর অস্ত্র-শস্ত্র সোনালী গিল্টি করা৷ তারা পাহারা দিচ্ছে যাতে ফারাও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন৷ মনে পড়ছে তুতানখামুনের চেয়ারগুলোর কথা৷ একটা চেয়ার প্যাপিরাসের৷ সেটা একটু ছিঁড়ে গেছে৷ বাকিগুলো সোনার পাতে মোড়া৷ সোনায় মোড়া চেয়ারের পিঠের কাছে তুতানখামুন আর তাঁর স্ত্রী আনখ-সেন-আমুনের ছবি৷ তুতানখামুন বসে আছেন, আনখ-সেন-আমুন তার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর গায়ে সুগন্ধি তেলের প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছেন৷ দুর্দান্ত কাজ৷ এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে৷ সেই অ্যালবাস্টার ভাসগুলো দেখলাম যার মধ্যে লোটাস আর প্যাপিরাসের বীজ পাওয়া গেছিল৷ তিনখানা গোল্ডপ্লেটেড খাট৷ মমি তৈরীর সময় এই খাটেই শোয়ানো হয়েছিল ফারাওকে৷ তারপর আসল বিস্ময়৷ তুতানখামুনের সমাধির ইনার চেম্বারটির থেকে সামান্য ছোটো একটি গোল্ডপ্লেটেড বাক্স৷ তারমধ্যে আরেকটি বাক্স৷ তারমধ্যে আরো একটি৷ তারও মধ্যে আরো একটি৷ প্রতিটি গোল্ডপ্লেটেড৷ সবচেয়ে ছোটো বাক্সটির মধ্যে ছিল একটি গোল্ডপ্লেটেদ কফিন যেটা ১৭ তারিখ তুতানখামুনের সমাধির মধ্যে দেখে এসেছি৷ তার মধ্যে ছিল ঠিক সেই রকমই আরেকটি কফিন৷ কিন্তু এই কফিনটি নিখাদ সোনার৷ মিউজিয়ামের কাঁচের ঘরে এই কফিনটা দেখে মুখ দিয়ে কোন কথা সরছিল না৷ সোনার কফিনের গায়ে অপুর্ব কারুকার্য৷ সেমি প্রেশাস স্টোনের ছড়াছড়ি৷ তার মধ্যে আরো একটি কফিন৷ এবং এটিও সোনার৷ আয়তনে আগেরটির চেয়ে সামান্য ছোটো৷ আগেরটির মতই অসাধারন কারুকার্য৷ এটাই শেষ কফিন৷ এর মধ্যেই রাখা ছিল মমিকৃত দেহ আর সেই মমির মুখ ঢাকা ছিল সেই সোনার মুখোসে যে মুখোস থেকে আমার মিশর মুগ্ধতার সুত্রপাত৷ কাঁচের বাক্সে রাখা মুখোসটার দিকে অনেকক্ষন চেয়ে রইলাম৷ অদেখা বাল্যপেমকে প্রথম দেখার মত এক অসাড় অনুভুতি৷ কিছুই আর ভাবতে পারছিলাম না৷ আমার মিশর যাত্রা এই মুহুর্তটিতে এসে যেন পূর্ণতা পেল৷
এতোদিন যা শুধুই বইএর পাতায় বা ডিসকভারীর শোতে দেখেছি সেগুলো চোখের সামনে দেখেতে পেয়ে অবিশ্বাস্য লাগছিলো৷ বেশি সময় ছিল না৷ তাই ভিভিয়ান যেটুকু দেখালো সেটুকু দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল৷ পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো সাদা পাথরের স্ল্যাবের ওপর আঁকা ছবি দেখলাম৷ পাঁচটি পাখির ছবি৷ দুটি মেয়ে৷ তিনটি পুরুষ৷ কয়েকটি পাখি জলাশয়ে খুঁটে খুঁটে শিকার করছে৷ একটি সবে ওড়ার জন্য পাখনা মেলেছে৷ পাঁচহাজার বছরের পুরোনো তুলিতে সে কি গতি, রঙের কি দীপ্তি! আলতামিরার বাইসন কোনদিন দেখতে পাবো কিনা জানি না৷ কিন্তু এই পাখির ছবি দেখে মনে হল আগন্তুকে উত্পল দত্তের মুখ দিয়ে সত্যজিত্ যা বলিয়েছিলেন তা একদম ঠিক৷ এমন আঁকতে না পারলে আঁকা শেখার কোন মানেই হয় না৷ দেখলাম সেই স্ক্রাইবের মুর্তি৷ রাজসভায় যা কথা হচ্ছে সব সে লিখে নিচ্ছে৷ চোখদুটি ফারাওএর দিকে নিবদ্ধ৷ নির্নিমেষ সেই দৃষ্টি কি অসম্ভব জীবন্ত! ভিভিয়ান তার হাতের তর্চ ফেললো স্ক্রাইবের দুই চোখের মণির ওপর৷ শিউরে উঠলাম৷ এক পুরোহিতের মুর্তি দেখলাম৷ তার চুল এবং গোঁফ দুইই আছে৷ মিশরীয় পুরোহিত মাত্রেই ক্লিনশেভড - এই ধারনাটা ভুল প্রমান হল৷ শেষ কুড়ি মিনিট ভিভিয়ান আমাদের দিয়েছিল নিজেদের মত ঘুরে দেখার জন্য৷ অতো বড়ো মিউজিয়ামে কুড়ি মিনিটে আর কি হবে৷ এলোপাথারী ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষন এবং ভিভিয়ান ছাড়া যে আমরা একেবারেই অচল সেটা অনুভব করলাম বেশ ভালো ভাবেই৷ কায়রো মিউজিয়ামের কালেকশন প্রচুর হলেও ডকুমেনটেশন বিশেষ ভালো নয়৷ আমরা একটা সার্কোফেগাসের ঘরে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষন৷ ফিফটি পার্সেন্ট সার্কোফেগাস জাস্ট এমনি পড়ে আছে৷ কার সার্কোফেগাস, কোথায় পাওয়া গেছিল, যে ছবি আঁকা আছে তার অর্থ কি - এসব কিচ্ছু লেখা নেই৷ একটা কালো পাথরের স্ল্যাব দেখলাম৷ তার গায়ে এক নগ্ন শিশুর ছবি আঁকা৷ এতোদিন যা মিশরীয় আর্ট দেখেছি এ তার চেয়ে একেবারে আলাদা৷ কিন্তু কিচ্ছু লেখা নেই৷ ওটা যে কি তা আর জানা হবে না কোনদিনও৷
নটে গাছটি মুড়োনোর সময় এগিয়ে আসছে৷ মিশর থেকে ফেরার সময় যেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল, মনে হচ্ছিল এতো দিন একটা মিশন ছিল লাইফে - সেটা শেষ হয়ে গেল - এই ডায়েরীর শেষে এসেও মনে হচ্ছে আমার ছোটোবেলার রূপকথার অধ্যায় সত্যিই শেষ হল৷ এর পর এটা শুধুই একটা স্মৃতি হয়ে যাবে৷ শেষ সন্ধ্যায় আমাদের জন্য একটা গালা ডিনারের ব্যবস্থা ছিল নীলনদের ওপরে৷ ভাসমান রেস্টোরান্টে খাওয়াদাওয়া৷ তার সাথে বেলি ড্যান্সের আসর৷ খাওয়টা ছিল পুরোপুরি অ্যামেরিকান স্টাইলে৷ আমাদের বিশেষ ভালো লাগে নি৷ তবে বেলি ড্যান্স খুব ভালো লাগলো৷ আরো ভালো লাগলো বেলি ড্যান্স শুরু হওয়ার আগে একটি ছেলের নাচ৷ নাচটার নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না৷ ছেলেটি এক হাজার বার পাক খেলো৷ অ্যারাবিক মিউজিকের আবহে হাজারপাকের নাচ অসাধারন লাগছিল৷ তবে মনে হচ্ছিল এই নাচ এই সুসজ্জিত বিলাসবহুল প্রমোদতরনীতে বেমানান৷ এই নাচ হওয়া উচিত ছিল দিগন্ত বিস্তৃত সাহারার বুকে আগুন জ্বালিয়ে৷
পরের দিন সকাল দশটায় ছিল ফ্লাইট৷ কায়রো এয়ারপোর্টের মত বিশৃঙ্খল এয়ারপোর্ট আমি আর একটাও দেখি নি৷ আমরা টার্মিনালে পৌঁছে গেছিলাম সকাল সাতটার মধ্যে৷ অজস্র বোঁচকা-বুঁচকি ঠেলে তিনবার সিকিউরিটি চেক-ইনের মধ্য দিয়ে যখন গেটে পৌঁছোলাম তখন বাজে সাড়ে নটা৷ মাঝখানে কি হল তা জানার জন্য মুজতবা আলি পড়ে নিন৷ কাবুলের রাস্তা আর কায়রো এয়ারপোর্টে বিশেষ তফাত্ নেই৷ এবং এতো কিছুর পরেও আমার ক্যারি অন লাগেজে এক বোতল জল ছিল, সেটা আমার ব্যাগেই রয়ে গেল৷ ফেরার প্লেনে চেপে বসলাম৷ রুক্ষ বালির শহর ভুমধ্যসাগরের নীলে মিশলো৷ তারপর আর কিছু দেখা গেলনা৷
আজ আমরা মিশর যাচ্ছি৷ এটুকু লিখেই একটা অদ্ভুত অনুভুতি হল৷ যেন এখনো বিশ্বাসই করতে পারছি না৷ মনে হচ্ছে একটা স্বপ্ন দেখছি, এখনি ভেঙে যাবে৷ মিশরের সাথে প্রথম কবে পরিচয়! ..... অনেক ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে৷ কোন এক আনন্দমেলা পুজোসংখ্যায় বেরিয়েছিল শৈলেন ঘোষের গল্প৷ এক ফারাও আর তার ছোট্টো মেয়েকে নিয়ে৷ সেই প্রথম ভালো লাগা৷ সুর্যদেবতা রা, মৃত্যুদেবতা আনুবিসের সাথে মিশরের রহস্যমাখা ইতিহাসে প্রথম প্রবেশ৷ বোধহয় জীবনের প্রথম রোম্যান্স!!
আজ থেকে পাঁচবছর আগেও কল্পনা করিনি এই রূপকথার মাটিতে আমার পা পড়বে৷ কিন্তু গত কয়েকবছরে পৃথিবী এমন ছোটো হয়ে এসেছে - এখন বুঝি রূপকথাকেও ছোঁয়া সম্ভব৷ আমিও ছুঁতে চলেছি আর কিছুক্ষনের মধ্যেই৷ এখন আমরা প্লেনে৷ নিউ ইয়র্ক যাচ্ছি৷ জন এফ কেনেডী এয়ারপোর্ট থেকে বিকেলে ছাড়বে কায়রোর ফ্লাইট৷ বেশি না৷ আর মাত্রই চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধান৷ তারপর? নাহ .... এখনো ভাবতে পারছি না :) এই ফাঁকে আমরা কোথায় কোথায় যাবো তার একটা হিসেব দিয়ে নিই৷
১৬ নভেম্বর - কায়রো পৌঁছাবো দুপুর নাগাদ৷ যদি খুব টায়ার্ড না থাকি তাহলে খাল-এল-খালিল নামে কায়রোর বিখ্যাত বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা আছে৷ প্রাচীন এই বাজার মশলার জন্য বিখ্যাত৷ শুভর ইচ্ছা আছে এই বাজারে বসে হুঁকো টানার :) দেখা যাক এই প্ল্যান কতদুর সফল হয়৷
১৭ তারিখ আমরা ঘুরছি ভ্যালি অফ কিংস, ভ্যালি অফ কুইন্সে৷ এই সমাধিগুলো আনুমানিক দেড়হাজার খ্রীষ্টপুর্বাদের৷ পিরামিডের পরের যুগের ফারওরা এখানে সমাধিস্থ হয়েছে৷ শুধু ফারাও নয়, তাদের আত্মীয়রাও৷ এমনকি অনেক সময় রাজ পরিবারের সাথে সম্পর্কিত অভিজাতরাও৷এদিন আরো দেখছি রানী হশেপসুতের মন্দির৷ ক্লিওপেট্রাকে বাদ দিলে এই রানীই মিশরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মহিলা ফারাও৷ আনুমনিক দেড়হাজার খ্রীষ্টপুর্বাব্দ নাগাদ ইনি বাইশ বছর রাজত্ব করেন৷ এর মৃত্যুর পর এর সব চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছিল রাজপরিবারের ইতিহাস থেকে৷ মেয়ে হয়ে পুরুষের কাজ করার শাস্তি!!
১৭ তারিখ আরো দেখছি কলোসি অফ মেনন৷ নীলনদের তীরে আমেনহোতেপের এই বিশাল মুর্তি থেকে একসময় অদ্ভুত সব আওয়াজ বেরোতো৷ লোকে ভাবতো দেবতা অসন্তুষ্ট হয়েছেন৷ তারপর একবার মুর্তিটি মেরমত করতে গিয়ে এই আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায় :)
১৮ নভেম্বর - এদিন যাবো কার্নাক টেম্পলে৷ প্রাচীন পৃথিবীর সব চেয়ে বড়ো ধর্মস্থান যা আজও টিকে আছে৷
২০ নভেম্বর - এইদিন যাচ্ছি অসোয়ানের বিখ্যাত বাঁধ দেখতে৷ এটা অবশ্য প্রাচীন পৃথিবীর নিদর্শন নয় ষাটের দশকে তৈরী৷ তারপর যাবো রানী হশেপসুতের আমলে তৈরী হওয়া অসমাপ্ত ওবেলিস্ক দেখতে৷ তৈরী শুরু হওয়ার কিছুদিন পর এটা কোন কারনে পরিত্যক্ত হয়৷ সাড়ে তিন হাজার বছর আগের মানুষেরা কি ভাবে পাথর কেটে কেটে এই বিশাল তোরনগুলো বানিয়েছিল তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় এই অসমাপ্ত ওবেলিস্কটা দেখলে৷ তারপর যাবো ফিলিতে আইসিসের মন্দির দেখতে৷ আইসিসের গল্প তো আগেই বলেছি৷ আইসিসের পুজা একসময় মিশরে এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে আইসিসের নাম মিশর ছড়িয়ে পৌঁছে যায় গ্রীস-রোমে৷ গ্রীক দেবী আফ্রোদাইত আর আইসিসের মধ্যে মিল খুঁজে পান কেউ কেউ৷
২১ নভেম্বর - পিরামিড, স্ফিংক্স আর ইজিপ্সিয়ান মিউসিয়াম দেখবো৷ তুতানখামুনের সোনার মুখোশ - আনন্দমেলায় প্রচ্ছদে যার ছবি দেখে প্রথম পাগল হয়েছিলাম - সেই মুখোশ দেখবো নিজের চোখে - স্বপ্ন নয়, সত্যিকারের মুখোশ!!
২২ তারিখ ঘরে ফেরা৷
১৫ নভেম্বর, বিকেল ৩:৪৬, জে এফ কে এয়ারপোর্ট
১৬ নভেম্বর, বিকেল ৪:৩০, কায়রো
১৮ নভেম্বর, সকাল ৮:৪৫, নীলনদ
গত দুদিনে যা যা দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করবো এমন ক্ষমতা আমার নেই৷ কথাটা খুব ক্লিশে শোনালেও সত্যি৷এতোদিন যা শুধু বইএর পাতায়, টিভির পর্দায় আর কল্পনার চালচিত্রে দেখে এসেছি তা নিজের চোখের সামনে দেখা, শুধু দেখাই নয় হাত দিয়ে ছোঁয়া - আমার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে৷
১৬ তারিখের সন্ধ্যা দিয়ে শুরু করি৷ বাসে করে আমাদের ওল্ড কায়রো নিয়ে যাওয়া হল৷ অনেকক্ষনের রাস্তা৷ কায়রোর রাস্তায় সিগনালের কোন বালাই নেই৷ যে যার নিজের ইচ্ছামত গাড়ি চালাচ্ছে এবং অবশ্যম্ভাবী অ্যাক্সিডেন্টগুলো ও নিপুণ কুশলতায় বাঁচিয়ে চলেছে৷ সেদিন ছিলো শুক্রবার৷ কায়রো শহরে অজস্র মসজিদ৷ খুব সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো৷ একটা মসজিদে বেশ ভীড় দেখলাম৷ আমাদের গাইড মিমো জানালো ওখানে বিয়ে হচ্ছে৷ আমাদের হোটেলেও সেদিন একটা বিয়ের রিসেপশন হচ্ছিলো৷
কায়রোর মেয়েদের পোষাক বেশ বৈপরিত্যে ভরা৷ বিয়েতে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আপদমস্তক বোরখাধারিনীও আছে, আবার অফশোল্ডার সাহসিনীও আছে৷ তবে রাস্তায় কোন অফশোল্ডার চোখে পরলো না, এমনকি কোন ওয়েস্টার্ন আউটফিটও না৷ রাস্তায় সবাই বোরখা৷ মুখ খোলা অবশ্য৷ ছেলেরা বেশিরভাগই সাধারন শার্টপ্যান্ট৷ কিছু এখান্কার ট্র্যাডিশনাল পোষাক পরা৷ লম্বা ঢিলেঢালা আলখাল্লা টাইপের পোষক - নাম গালাবা৷ কায়রোর রাস্তা দেখতে দেখতে দেশের কথা মনে পড়ছিলো৷ ঐ রকমই ট্রাফিক আইন না মানা মানুষ, ঐ রকমই স্টেশনারী দোকান রাস্তার ওপর৷ কতোদিন পর টিনের শাটার দেখলাম :) পথে পড়লো মহম্মদ আলি মস্ক৷ আঠারো শতকের তৈরী এই মসজিদের অপুর্ব স্থাপত্য৷ রাতের আলোয় আরো মোহময়ী লাগছিলো৷ আমার ইচ্ছা ছিলো এটা দেখার৷ কিন্তু আমাদের আইটিনেরারীতে ছিলো না৷ রাস্তায় দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগলো৷ তবে ছবি নেওয়া গেল না - এই যা দু:খ৷
মিমো আমাদের নিয়ে এলো একটা ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যে৷ পাশে কোন মসজিদ থেকে তখন জোরে আজান দিচ্ছে৷ গাড়ীর হর্ণ, অজস্র বাস, গিজগিজে ভীড় - মনে হচ্ছিল দিল্লীতে আছি৷ একটা বড় দেওয়ালের
সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শোতে স্ফিংক্সের মুখ দিয়ে মিশরের ইতিহাস বলানো হল৷ জানা গল্প, নেট ঘাঁটলেই আজকাল পড়া যায়৷ কিন্তু ঐ সময়ে পিরামিডের সামনে বসে ঐ শোনা গল্পগুলো ই আবার শুনতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো৷ সাড়ে চারহাজার বছরের পুরোনো এই পিরামিড৷ একসময় বাইরের পাথরগুলো এতো চকচকে ছিলো যে সুর্যের রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সারা মিশর এর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো৷ আমুন-রায়ের পুরোহিতেরা দেখেছে এই পিরামিড, রামেসিস, আমুনহোতেপ, রানী হাতশেপসুত, কিশোর রাজা তুতানখামুন, ব্যক্তিত্বময়ী ক্লেওপেট্রা, ইতিহাসের জনক হেরোডেটাস, দিগবিজয়ী আলেকজান্ডার, শত শত গ্রীক, রোমান, মুসলিম, খ্রীষ্টান সৈনিক - আর আজ আমরাও দেখলাম এই অতুলনীয় সৃষ্টি৷ অতুলনীয় কারন এটা মানুষের হাতে গড়া৷ আজকের মানুষ নয়, সাড়ে চারহাজার বছর আগের মানুষ - এমন পুর্বপুরুষের কথা ভাবলে মনে গর্ব হয়, অনুপ্রেরনা জাগে৷ আর কিছুদিন পর আমরা কোন অতলে চলে যাবো৷ কিন্তু এই পিরামিড থাকবে৷ আমরা যে এখানে এসেছিলাম মনে রাখবে কি? আমরা এই ইতিহাসের একটা বিন্দু হয়ে বেঁচে থাকবো কি? এই বিশালত্বের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম অনুভব করতে পারছি মানুষের অমর হওয়ার ইচ্ছা কি প্রবল! মানুষ শুধু বাঁচতে চায় না৷ ছাপ ফেলে যেতে চায়৷ "আনন্দাত্ জায়তে বিশ্ব, আনন্দাত্ পল্যতে তথা, আনন্দাত্ লীয়তে বিশ্ব, আনন্দ পরিপুরত:"৷ মানুষ চলে যাওয়ার পরেও এই পৃথিবীতে তার আনন্দটুকু রেখে যায়৷ পৃথিবীর আকাশে-বাতাসে তার আনন্দকণা ভেসে থাকে৷ পরের প্রজন্মের মানুষ সেই আনন্দ আঁজলা ভরে তুলে নেয়৷ আজ যেমন আমরা আড়াইহাজার খ্রীষ্টপুর্বাব্দের বুদ্ধি-শ্রম আর সৃষ্টির আনন্দ আকণ্ঠ পান করলাম৷
এতক্ষন কেবিনে বসে লিখছিলাম৷ এবার ডেকে উঠে এলাম৷ ভীষন ভালো লাগছে নীলনদের ওপর ভেসে বেড়াতে৷ আমার এক পাশে রুক্ষ পাহাড়, অপর পাশে সবুজ৷ কিন্তু সে কথা পরে৷ আগে কালকের গল্প বলে নিই৷
কাল ভোর দুটোতে উঠতে হয়েছে৷ লুক্সরের ফ্লাইট ছিল ভোর পাঁচটায়৷ লুক্সরে নেমে লাগেজ কালেক্ট করেই সাইট সিইং নাইলের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে৷ নীলনদের পশ্চিম উপকুল রুক্ষ, ধুষর, পাথুরে৷ ফারওরা তাই এই তীরটাকে বেছে নিয়েছিল তাদের শান্তিতে ঘুমনোর জায়গা হিসেবে৷ এই সমাধিগুলো কিন্তু পিরামিড নয়৷ পিরামিডগুলো সবই চার সাড়েচারহাজার বছর আগে তৈরী৷ পিরামিডের প্রবেশপথ যদিও গোপন রাখা হত, কিন্তু তা সজ্জ্বেও চুরিডাকাতি সেই প্রাচীনকালেও কিছু কম হয়নি৷ পিরামিডের অতুলনীয় ধনসম্পদের লোভে সেই যুগেও বহু লোক পিরামিড ভেঙে ঢুকেছে৷ তাই পরবর্তীকালের ফারওরা লুক্সরের কাছে নীলনদের পশ্চিমকুলের পাথুরে জমিকে বেছে নিয়েছিল তাদের সমাধির জন্য৷ মাঠির নিচে সমাধিকক্ষ তৈরী করে তার মুখ এমনভাবে বন্ধ করে দেওয়া হত যাতে কেউ খুঁজে না পায়৷ এই সমাধিস্থলই ভ্যালি অফ কিংস আর ভ্যালি অফ কুইনস৷ ভ্যালি অফ কিংসে মুলত ফারওদের সমাধি দেওয়া হত৷ ভ্যালি অফ কুইনসে রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের৷
এর পর গেলাম ভ্যালি অফ কিংসে৷ এখানেও ছবি নেওয়া যাবে না৷ আমরা গেলাম চতুর্থ রামেসিস, নবম রামেসিস আর তুতানখামুনের সমাধিতে৷ তুতানখামুনের জন্য আলাদা টিকিট কাটতে হল ৮০ ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড দিয়ে৷ বাকিগুলো আমাদের প্যাকেজে ইনক্লুডেড৷ চতুর্থ রামেসিসের সমাধি বেশ বড়ো৷ এই সমাধি অব্যশ্য বহুদিন
তারপর গেলাম বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিখ্যত ফারাও তুতানখামুনের সমাধি দেখতে৷ খুব ছোটো সমাধি৷ তুতানখামুন তো খুব একটা বিখ্যাত রাজা ছিলেন না৷ খুব অল্প বয়সেই মারা যান৷ তুতানখামুন বিখ্যত হয়েছেন মৃত্যুর তিনহাজার বছর পরে যখন জেমস কার্টার তাঁর প্রায় অবিকৃত সমাধিমন্দির আবিষ্কার করে৷ আর কোনো ফারওএর সমাধি থেকে এতো সম্পদ পাওয়া যায়নি৷ তার মানে অবশ্য এই নয় যে তুতানখামুনের সময় মিশর কিছু অতিরিক্ত সমৃদ্ধিশালী ছিল৷ সব ফারাওদের সমাধিতেই প্রচুর ধনসম্পদ ছিলো, কিন্তু সে সবই চুরি গেছে৷ সৌভাগ্যবশত তুতানখামুনের কথা সবাই ভুলে গেছিল৷ তাই তাঁর সমাধির ওপর হামলা হয়নি৷ বিশ শতকে তাঁর সমাধির অতুলনীয় সম্পদ দেখে আজকের মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে গেছে৷ এই তুতানখামুনের ছবি আনন্দমেলার প্রচ্ছদে দেখেই আমার মিশর মুগ্ধতার সুত্রপাত৷ তুতানখামুনের সমাধির করিডরে বিশেষ ছবি নেই৷ রাজার মৃত্যু যেহেতু অপ্রত্যশিত ছিল তাই খুব তাড়াহুড়োয় বানানো হয় এই সহ্মাধি৷ ইনার চেম্বারে কাচের বাক্সে রাখা রয়েছে তুতানখামুনের মমি৷ এবছরের নভেম্বর মাসের চারতারিখে তুতানখামুনের মমি খোলা হয়েছে৷ তাই এই মুহুর্তে ইজিপ্টোলজিতে তুতানখামুনের মমি হল সবচেয়ে বড়ো খবর৷ মমি আমরা আগেও দেখেছি৷ ঐতিহাসিক গুরুত্ব যতই হোক না কেন, আমাদের অশিক্ষিত চোখে এটা যে আলাদা কিছু তা কিন্তু নয়৷ কিন্তু মাটির তলায় সমাধিমন্দিরে তিনহাজার বছরের পুরোনো কিশোরের দেহাবশেষ দেখে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো৷ তিনহাজার বছর! মহাকালের নিয়মে হয়তো কিছুই নয়৷ কিন্তু আমাদের নশ্বর জীবনে আমরা তো কল্পনাই করতে পারি না৷ আত্মাই শুধু জন্মরহিত ও শাশ্বত নয়, প্রাচীন মিশরীয়দের দেহকেও শাশ্বত করে রাখার উপায় জানা ছিল!! তুতানখামুনের সমাধির দেওয়ালের ছবিগুলো আশ্চর্য জীবন্ত৷ হয়তো মানুষের আনাগোনা বেশি হয়নি বলেই রঙ বিশেষ নষ্ট হয়নি৷ তুতানখামুনের সাথে আইসিসের ছবি আছে দেওয়াল জুড়ে৷ এতো উজ্জ্বল যে দেখে মনে হচ্ছে কালই আঁকা হয়েছে বুঝি৷
এতো টায়ার্ড ছিলাম যে ভালো করে খেতেও পারলাম না৷ ঘরে ফিরে আধঘন্টা শুয়েই বেরিয়ে পড়তে হল৷
কার্নক টেম্পল দেখার পরেও যে কিছু দেখে ভালো লাগতে পারে তা ভাবি নি৷ ভুল ভাঙলো বাস এসে যখন দাঁড়ালো লুক্সর টেম্পলে৷ তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে৷ লুক্সর টেম্পল আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে৷ অসাধারন লাগছে মন্দিরের প্রবেশপথের দুইপাশে দ্বিতীয় রামেসিসের বিশাল মুর্তিদুটোকে৷ লুক্সরের মন্দির প্রাচীন কালে কর্নাক মন্দিরের সাথে
লুক্সর থেকে জাহাজে ফিরেই ডিনার৷ খুব ভালো ডিনার ছিল৷ ভালো খেয়েছি৷ তারপর টানা ঘুম৷ঘুম ভাঙলো সাড়ে পাঁচটায়৷ শুভ তখন আমায় ডাকছে সানরাইজ দেখতে যাওয়ার জন্য৷ একটা হাল্কা সোয়েটার চাপিয়ে ডেকে উঠে এলাম৷ তখনো আবছা অন্ধকার৷ দুইপাশে ঘুমন্ত মিশর৷ আমরা ভেসে চলেছি নীলনদের ওপর দিয়ে৷ পাঁচহাজার বছরের মিশরীয় সভ্যতার কত উত্থানপতনের সাক্ষী এই নীলনদ৷ আজ আমরাও তার হিসেবের খাতায় ঢুকে গেলাম৷ পুব আকাশ ফরসা হয়ে সোনালী সুর্য মুখ বাড়ালো৷ আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো৷ মনে হল পাঁচহাজার বছরের কল্পনায় গড়ে তোলা সুর্যদেবতা রা আমাদের অভ্যর্থনা করলেন৷ এই পৃথিবীর প্রতিটি ধুলিকণায় মিশে আছে যে অপরিসীম বিস্ময় - সেই বিস্ময়ে বিস্মিত হওয়ার আশীর্বাদ আমরা পেয়ে গেলাম৷
ব্রেকফাস্ট খেয়ে লিখতে বসেছিলাম৷ এখন বেলা গড়িয়ে দুপুর৷ বিকেলে পৌঁছবো এডফুতে৷ সে গল্প পারলে লিখে ফেলবো আজ রাতেই৷
২০ নভেম্বর, বিকেল ৩:৪৫, অসওয়ান এয়ারপোর্ট
অসওয়ান এয়ারপোর্টে বসে আছি৷ কায়রো যাবো৷ কাল সারাদিন কায়রো ঘোরা৷ তারপর মিশরকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফেরা৷ গত দুদিন যে কেমন ভাবে কেটে গেল! সারাদিন নীলনদে ভেসে বেড়ানো৷ মাঝে মাঝে তরী ভিড়ছে তীরে৷ দুহাজার বছরের পুরোনো মানুষের অপুর্ব সৃষ্টি ভেসে উঠছে চোখের সামনে৷ এখানে সবাই দেখছি ভারতীয়দের বেশ পছন্দ করে৷ পরশু সালোয়ার কামিজ পড়েছিলাম৷ সন্ধ্যাবেলা আমাদের বোট এডফু পৌঁছালে আমরা টাঙ্গায় চেপে চললাম হোরাসের মন্দির দেখতে৷ এডফু একেবারে পশিমবঙ্গের সাধারন মফস্বল শহরের মতই৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে, দোকান ঘরের সামনে ছেলেছোকরাদের জটলা৷ আমাদের দেখেই তারা চেঁচিয়ে উঠছে "ইণ্ডিয়া! অমিতাভ বচ্চন! রানী মুখার্জী!!" যা বুঝলাম বলিউডের দেবতারা বেশ ভালই পুজো পান এখানে :)
এডফুর হোরাসের মন্দির দুহাজার বছরের পুরোনো৷ এবং রঙ বাদে প্রায় পুরোটাই অক্ষত৷ হোরাসের গল্প আগেই বলেছি৷ মৃত্যুদেবতা ওসিরিস আর
সেদিন আমাদের ক্রুজে ইজিপশিয়ান ডিনার ছিল৷ দুর্দান্ত খেলাম৷ কালোজিরে দেওয়া একরকম রুটি - অনেকটা আমাদের খাস্তা নিমকির মত৷
ওহো - বলতে ভুলে গেছি৷ দুপুরে বোট যখন লকগেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তখন দেখি একগাদা ছোটো ছোটো নৌকা আমাদের ছেঁকে ধরেছে৷ ঐ নৌকাগুলো আসলে ছোটো ছোটো দোকান৷ দোকানীরা নৌকো থেকে আমাদের ডেকে ছুঁড়ে দিচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা গালাবা আর জিলাবিয়া৷ গালাবা আর জিলাবিয়া হল ট্র্যাডিশনাল মিশরীয় পোষাক৷ ছেলেদের গালাবা আর মেয়েদের জিলাবিয়া৷ দুটো ই পা পর্যন্ত লম্বা আলখল্লা টাইপের পোষাক৷ রাতে আমাদের ক্রুজে ইজিপসিয়ান নাইট ছিল৷ তাই অনেকেকেই কিনে নিল পার্টির পোষাক৷ আমিও আমার কেবিনের জানলা দিয়ে কিনে নিলাম একটা শাল৷ নৌকা থেকে প্লাস্টিকে ভরে আমায় শাল ছুঁড়ে দিল৷ প্রথমে চাইলো দুশো ইজিপশিয়ান পাউন্ড৷ শুভ সেটাকে দরাদরি করে পঞ্চাশে নামিয়ে আনলো৷ প্লাস্টিকে ভরে টাকা ছুঁড়ে দিলাম নৌকায়৷
মিশরের আরো অনেক মন্দিরের মত এই মন্দিরের দেওয়ালেও লোটাস, প্যাপিরাস, বিভিন্ন শস্যের ছবি আঁকা৷ তার এক পাশে রাজার, আরেকপাশে দেবতার ছবি৷ রাজা এই সব কিছু দেবতাকে নিবেদন করবেন৷ ভিভিয়ান আমাদের নিয়ে গেল এক জায়গায় যেখানে হায়রোগ্লিফিক্সে প্রাচীন মিশরীয় ক্যালেন্ডার খোদাই করা আছে৷ বছরের প্রতিটা দিন খোদাই করা আর তার পাশে সেই দিনে দেবতাকে কি নৈবেদ্য দেওয়া হবে তার ছবি৷ আরেকটি দেওয়ালের একাংশে শুধু দুটো চোখ আর কান আঁকা আছে৷ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সব শুনছেন, সব দেখছেন৷
কম-অম্বোর এই মন্দিরের গর্ভগৃহ দুটি৷ একটা সোবেকের জন্য৷ আরেকটা হোরাসের জন্য৷ দুই গর্ভগৃহের মধ্যে যে দেওয়াল তার ভেতরটা ফাঁপা৷ সেখানে নেমে গেছে একটা সুড়ঙ্গ৷ রাজা যাখন মন্দিরে প্রার্থনা করতে আসতেন প্রধান পুরোহিত তখন নেমে যেতেন ঐ সুড়ঙ্গে৷ রাজা দেবতার সাথে কথা বলতেন৷ দেবতার হয়ে উত্তর দিতেন পুরোহিত৷ রাজা এই চালাকিটা ধরতে পারলেও তাঁর কিছু করার ছিল না৷ এতো জানাই আছে ধর্মের আফিম রাজার তলোয়ারের চেয়েও শক্তিশালী৷
হোরাসের মন্দিরে বেশ কিছু জায়গায় রঙ এখনো মুছে যায়নি৷ দুহাজার বছরের রোদ-জল উপেক্ষা করে এখনো ঝলমল করছে৷ আমরা যখন গেছিলাম তখন ওখানে আমরা ছাড়া আর কেউ ছিল না৷ নীলনদের হাওয়া দুহাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসের গন্ধ বয়ে আনছিল৷ প্রায় ফাঁকা মন্দিরে আমরা দুজনে অনেকক্ষন ঘুরে বেড়ালাম৷ একটা ঘুপচি ঘরে স্টেথোস্কোপ কানে দেওয়া এক ডাক্তারের ছবি পাওয়া গেল৷ তার পাশে ঐ রকমই একটা অন্ধকার ঘরে এক রানীর ছবি দেখিয়ে স্থানীয় এক মানুষ বললো ক্লিওপেট্রা৷ সত্যি করেই ক্লিওপেট্র কিনা জানি না, তবে লোকটা দুই ডলার বখশিশ আদায় না করে পিছু ছাড়লো না৷ আমরাও বোটে ফিরে এলাম৷ ভেসে চললাম অসওয়ানের দিকে৷
২২ নভেম্বর, দুপুর ১২:৩৮, ফেরার বিমানে অ্যাটলান্টিকের ওপর
আজ ফিরছি৷ খানিক পরেই নিউ ইয়র্ক পৌঁছাবো৷ সাত দিনের এই মিশর ভ্রমনে মন এমন কানায় কানায় ভরে আছে যে ঘরে ফিরে কাজে মন দেওয়া মুশকিল হবে৷ ১৯ তারিখের রাতে অসওয়ান পৌঁছলাম৷ রাতে ভিভিয়ান আমাদের অসওয়ানের বিখ্যাত স্পাইস মার্কেটে নিয়ে গেল৷ মশলার গন্ধে ম ম করছে৷ আমি অবশ্য মশলা কিনিনি৷ কিছু প্যাপিরাস কিনলাম৷ এখানে বাজারে ভীষন দরদাম করতে হয়৷ ওরা যা চাইবে তার ১/৬ দিয়ে শুরু করা দস্তুর৷ আমাদের সঙ্গী আমেরিকানরা এসব দেখে ভ্যবাচ্যাকা৷ আমরা কয়েকজনের হয়ে বার্গেন করে দিলাম৷ অসওয়ানই আমাদের ক্রুসের গন্তব্য ছিল৷ ২০ সকালে ক্রুসে চেক আউট৷ তারপর সারাদিন অসোয়ান সাইট সিয়িং৷ বিকেলের প্লেনে কায়রো ফেরা৷
মন্দিরের দেওয়ালের ছবি থেকে দেবতার মুখ খুবলে নেওয়া হয়েছে৷ খ্রীষ্টধর্ম প্রসারের সময় যারা বাধ্য হয়েছিল ধর্মান্তরিত হতে, অথচ মনে মনে বিশ্বাস করতো মুর্তিপুজাতেই - তারা হয়তো ভয় পেয়েছিল দেবতার রোষের৷ তাই বিকৃত করে দিয়েছিল মুর্তির মুখ৷ ভেবেছিল মুখ বিকৃত করে দিলে হয়তো দেবতা আর দেখতে পাবেন না তাদের৷ আরেকটা ইন্টারেস্টিং তথ্য বলে নিই এই ফাঁকে৷ প্রাচীন পেগান সভ্যতাগুলোর মত মিশরীয়রাও বিশ্বাস করতো সিমেট্রিতে৷ তাই মিশরীয় মন্দিরগুলো বামদিকটা অনেকসময়ই ডানদিকের মিরর ইমেজ৷ অনেক মন্দিরের ধ্বংসস্তুপে তাই দেখেছি শুধু বামদিকটা বা শুধু ডানদিকটা বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে৷ একদিকটা নষ্ট করে দিলেই সিমেট্রি নষ্ট হয়ে গেল৷ আর সেই সাথে নষ্ট হয়ে গেল সংশ্লিষ্ট দেবতার শক্তিও - এই রকমই বিশ্বাস৷
আইসিসের মন্দিরের দেওয়ালে দেখেছি ল্যাটিন-কোপটিকে লেখা অজস্ব গ্রাফিতি৷ বেশকয়েকটা পিলারে পুরোনো ছবিকে মুছে দিয়ে খোদাই করা আছে ক্রশ৷ তবে সেই ক্রশ কিন্তু আমরা এখন যে ক্রশ দেখি সেই রকম নয়৷ সিমেট্রিক ক্রশ৷ চারটে বাহুই সমান, একইরকম৷ বুঝতে পারছিলাম যুগপরিবর্তনের এক সন্ধিক্ষনের সাক্ষী হয়েছি৷ এই প্রসঙ্গে একটা নিজস্ব অবসারভেশনের কথা লিখে আইসিস মন্দিরের গল্প শেষ করি৷ প্রায় সব মিশরীয় দেবতাই হাতে একটা বিশেষ চিহ্ন ধরে আছেন দেখলাম৷ এর নাম ankh ৷ এই চিহ্নের অর্থ হল iternal life ৷ এখন আমরা যে ক্রশ চিহ্ন দেখি তার সাথে ankh এর ভীষন মিল৷ আমাদের গ্রুপের একটি মেয়ে ankh পরেছিল গলায় লকেট করে৷ আমি প্রথমে সেটাকে ক্রশ ভেবেছিলাম৷ আমাদের গাইড ankh এর দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করার পর বুঝলাম মেয়েটি ankh পরেছে৷ ankh এর ওপরের অংশ একটা চোখের মত৷ বাকি অংশ সাধরন ক্রশের মত অ্যাসিমেট্রিক৷এর পর আর বিশেষ কিছু দেখার ছিল না সেদিন৷ পথে অসওয়ান হাই ড্যামে বাস থামলো একবার৷ বিশাল এই ড্যামের পাশেই মানুষের তৈরী পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো জলশয় লেক নাসের৷ মিশরের রুক্ষ দক্ষিনপ্রান্তে এই জলাশয় মিশরের বর্তমান অর্থনীতিতে অসামন্য গুরুত্বপুর্ন হলেও প্রাচীন মিশরের নেশায় এমন বুঁদ হয়েছিলাম যে এই লেকটির দিকে বিশেষ মন দিতে পারলাম না৷ বাস চললো এয়ারপোর্টে৷ পড়ন্ত বিকেলের আলোয় রুক্ষ ধুষর অসওয়ানকে বিদায় জানিয়ে আমরা উড়ে চললাম কায়রোর দিকে৷
২৬ নভেম্বর, ব্যাটেলক্রিক, সকাল ৯:৩৭
মিশর থেকে ফিরেছি তিনদিন হয়ে গেল৷ আসার পর থেকেই সেমেস্টার শেষের চাপ আর বাড়ী ফেরার অপরিসীম আলস্য যেভাবে একসাথে সাঁড়াশী আক্রমন চালিয়েছিল যে ভাবছিলাম আমার আরো পাঁচটা কাজের মত এই মিশর ডায়েরীও অসমাপ্ত রয়ে যাবে বুঝি৷ আজ অফিসে এসে দেখি কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ রেসপন্ড করছে না৷ কাজকর্ম শিকেয় তুলে তাই মিস্তিরীর অপেক্ষায় বসে আছি৷ আর সেই অবসরে চলছে ডায়েরী লেখা৷
২১ তারিখ সকালটা ছিল পিরামিড আর স্ফিংক্সের জন্য৷ ভোরে ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে দেখি হোটেলের লবি থেকে পিরামিড দেখা যাচ্ছে৷ ব্রেকফাস্ট খাওয়া মাথায় উঠলো৷ ছবি তুলতে ছুটলাম৷ তারপর সত্যিই যখন বাসে চেপে বসলাম আর আমাদের গাইড জানালো আমরা এখন চলেছি গিজাতে
পিরামিডের সামনে একটা ছোটো কি-অস্কে টিকিট বিক্রি হচ্চে৷ টিকিট কিনে আমরা লাইনে দাঁড়ালাম৷ ভিভিয়ান আমাদের আগেই সাবধান করে দিয়েছিল পিরামিডে ঢোকার পথ একটা ছোটো সুড়ঙ্গের মত৷ পাশাপাশি বড়জোর দুজন চলতে পারে৷ ছাদ এতো নিচু যে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে হবে৷ ভেতরে কোন ভেন্টিলেশন নেই৷ তাই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে পারে৷ ভিভিয়ানের কথা একান দিয়ে ঢুকে ওকান দিয়ে বেরিয়ে গেছে৷ মিশরে এসে সুযোগ পেয়েও পিরামিডে ঢুকবো এ আবার হয় নাকি৷ আর গাইডেরা অনেক সময়েই বাড়িয়ে বলে৷ সেবারে ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে রাইড নেওয়ার সময়েও অনেকে সাবধান করেছিল৷ কিছুই তো হয়নি৷ ভিভিয়ান যে ফাঁকা বুলি আওড়ায়নি সেটা বুঝলাম একটু পরেই৷ বড়োজোর তিনফুট চওড়া সুড়ঙ্গের একদিক দিয়ে মানুষ ঢুকছে, অন্যদিক দিয়ে বেরোচ্ছে৷ সুড়ঙ্গটি আবার সোজা নয়, সেটা বেঁকে গেছে নিচের দিকে৷ দেওয়ালে খানিক দুরে দুরে আলো লাগানো আছে বটে, কিন্তু মোটের ওপর জায়গাটা অন্ধকার৷ এতো লোকের আনাগোনায় একটা ভ্যপসা বাষ্প তৈরী হয়েছে যেটা আমায় ক্লস্টোফোবিক করে তুলছিল৷ পিঠ বেঁকিয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সুড়ঙ্গ দিয়ে নামতে নামতে মনে হচ্ছিল এ পথের বুঝি আর শেষ নেই৷ অথচ সত্যি করে হয়তো বড়োজোর তিনমিনিট হেঁটেছি৷ সুড়ঙ্গ একসময় একটা ছোটো সমতল কুঠুরীতে এসে শেষ হল৷ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম৷ এখানে পাথরের দেওয়ালের গায়ে একটা ছোটো কুলুঙ্গীর মত৷ আর আমাদের ডানদিকে আরেকটা সুড়ঙ্গ অন্য একটা ঘরে চলে গেছে৷ সেটার দরজা বন্ধ৷ আন্দাজে মনে হল এটা রানীর সমাধি৷ কারন শুনেছিলাম রানীর সমাধিকক্ষটি বেশ ছোটো এবং সেটা বন্ধ আছে৷ কুঠুরী থেকে আরেকটা সুড়ঙ্গ এবার চলে গেছে ওপরের দিকে৷ সেই সুড়ঙ্গ ধরে চলতে শুরু করলাম৷ দেখলাম পিঠ বেঁকিয়ে ওপরের দিকে ওঠা অপেক্ষাকৃত সোজা৷ এবার কম কষ্ট হল৷ সুড়ঙ্গ শেষ হয়েছে একটা মাঝারী আকারের ঘরে৷ সেখানে একটা পাথরের সার্কোফেগাস (কফিন) রাখা৷ ব্যাস৷ আর কিছু নেই৷ চারহাজার বছর অগে হয়তো এই ঘরটিকে সোনাদানায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল৷ হয়তো সমাধিকক্ষে, সুড়ঙ্গের দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছিল ওসিরিসের সভায় শেষ বিচারের ছবি৷ এখন আর সেসবের কিছুই নেই৷ কালো পাথরের সার্কোফেগাসটার কাছে গিয়ে খানিকক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ভ্যপসা সুড়ঙ্গপথ৷ তার শেষে এই অপ্রশস্ত প্রায়ন্ধকার সমাধিকক্ষ৷ মনে হচ্ছিল সত্যিই অন্য এক দুনিয়াতে চলে এসেছি৷ অতো লোকের মাঝেও গা ছমছম করছিল৷ হতে পারে মুক্ত বাতাসের অভাবে৷ হতে পারে এতোক্ষন কুঁজো হয়ে হাঁটার জন্য৷ হতে পারে এতোদিনের পড়া গল্প আর সত্যিকরে পিরামিডের ভেতরে পা ফেলার অভিজ্ঞতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল বলে৷ শেষবারের মত ফারাও খেফরনের গোপনতম ঠিকানায় চোখ বুলিয়ে ফেরার পথ ধরলাম৷ আবার সেই বদ্ধ সুড়ঙ্গ৷ কতক্ষনে সুর্যের আলো দেখবো সেই আশায় হামাগুড়ি দিয়ে পথ চলা৷
পিরামিড থেকে ঘুরে আসার পাঁচ দিন পর এই লেখা লিখছি৷ এখনো ঘোর কাটেনি আমার৷ লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স কাকে বলে তা প্রথম বুঝেছিলাম ১৯৯৫ সালের অক্টোবর মাসে যখন পুর্ণ সুর্যগ্রহনের চুড়ান্ত মুহুর্তটিতে আকাশ-বাতাস এক অপার্থিব নীলাভ দ্যুতিতে ঢেকে গেছিল৷ আবার বুঝলাম ২০০৭ এর ২১শে নভেম্বর পিরামিডের মধ্যে পা রেখে৷ এ এমন এক বিস্ময়কর অনুভুতি যা লিখে প্রকাশ করবো এমন ভাষা আমার জানা নেই৷ দুটো ই যেন এক অন্য পৃথিবী থেকে ঘুরে আসা৷ এক চুড়ান্ত বিস্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে যাওয়া৷
অনেক প্রশ্ন ছিল মনে৷ কিছুই জিজ্ঞাসা করা হলনা ভিভিয়ানকে৷ এখন মনে হচ্ছে জানতে পারলে ভালো হত মিশরে সহমরন ছিল কিনা৷ রানীকে কি তার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর পিরামিডে নিয়ে গিয়ে সমাধি দেওয়া হত, নাকি কোন বিভত্স প্রথা জড়িয়ে ছিল এর সাথে যা ভাবতে গেলেও এখন আমার হাড় হিম হয়ে আসছে৷ প্রশ্ন জাগছে ঐ সুড়ঙ্গ আর সমাধিকক্ষটুকু বাদ দিলে বাকি পিরামিডটা কি ফাঁপা? কিছুই জেনে নেওয়া হয়নি৷ ঐ সরু সুড়ঙ্গের ওপারের মৃত্যুপুরী আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল৷ পিরামিড থেকে বেরোনোর পর ভিভিয়ান আমাদের নিয়ে এলো আরেকটা স্পটে যেখান থেকে স্ফিংক্সকে দেখা যায়৷
স্ফিংক্সের কথায় ফিরে আসি৷ ভ্যালি টেম্পলের পেছনের একটা দরজা দিয়ে বেরোতেই স্ফিংক্স একেবারে চোখের সামনে চলে এলো৷ স্ফিংক্স যে কত বিশাল তা এতোক্ষনে বুঝতে পারলাম৷ আর আরো অবাক করে দেওয়া ঘটনা হল এই বিশাল স্ফিংক্স কিন্তু পিরামিডের তুলনায় বেশ ছোটো৷ তিনটে পিরামিড আর স্ফিংক্স সহ সাহারার এই প্রান্ত এতো বিশাল যে আমাদের এতোদিনের বিশালত্বের ধারনা ওলটপালট হয়ে যায়৷ নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং বা শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার আমার মনে এই বিস্ময়ের জন্ম দেয়নি যদিও এই দুটো ই পিরামিডগুলোর চেয়ে অনেক উঁচু৷ রুক্ষ সাহারার বুকে সাড়ে চারহাজার বছরের পুরোনো মানুষের কীর্তিস্তম্ভ আমার মধ্যবিত্ত ধ্যানধারনায় সজোরে ধাক্কা মারে৷ আমার ঘোর কাটে না৷
২৭ নভেমবর, কালামাজু, রাত ৯:৪২
মিশরের গল্প প্রায় শেষ হয়ে এলো৷ গিজা থেকে ফেরার পথে ভিভিয়ান আমাদের নিয়ে গেল একটা এসেন্স শপে৷ বাহারী কাঁচের আতরদানীতে ভরা সেই দোকান যেন আরব্য উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে৷ সুদৃশ্য পেয়ালায় টার্কিশ কফিতে আমাদের আপ্যায়িত করে দোকানদার আমাদের এক হারিয়ে যাওয়া সুগন্ধির গল্প শোনাতে বসলো৷ লোটাস ছিল প্রাচীন মিশরের আদরের ফুল৷ প্রায় সব মন্দিরেই তাই আমরা লোটাস আর প্যাপিরাসের ভাস্কর্য দেখেছি৷ কিন্তু পেগান সভ্যতার অবসানের সাথে সাথে প্রাচীন মিশরের এই সম্পদটিও চিরতরে হারিয়ে গেছিল৷ বিশ শতকে হাওয়ার্ড কার্টার যখন তুতানখামুনের সমাধি প্রায় অবিকৃত অবস্থায় খুঁজে পেলেন তখন আর সব জিনিসের সাথে তিনি পেলেন কিছু অ্যালবেস্টার ভাস৷ সেই ভাসের মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য সুগন্ধি যার সুবাস তিনহাজার বছর পরেও অম্লান৷ শুধু গন্ধই নয়, অ্যালবাস্টার ভাসে পাওয়া গেল তিনহাজার বছরের পুরোনো পদ্ম আর প্যাপিরাসের বীজ৷ সেই বীজ থেকে হারিয়ে যাওয়া সুগন্ধি আবার ফিরে এলো মিশরে৷ এই বলে সে আমাদের মনিবন্ধে এক ফোঁটা করে লোটাস এসেন্স লাগিয়ে দিল৷ অপুর্ব মাদকতাময় সেই গন্ধ রাত পর্যন্ত আমার হাতে ছিল৷ আমার শ্বাশুড়ি মা সুগন্ধি ভালোবাসেন৷ তাঁর জন্য লোটাস নিলাম এক শিশি৷ আমার বরটিও ওমর শরীফ নামের একটি সুগন্ধি কিনলো৷ এর পেছনে কোন খানদানী গল্প না থকলেও গন্ধটি বড় মনোরম৷
খেতে খেতে দুটো বেজে গেছিল৷ কায়রো মিউজিয়াম বন্ধ হবে পাঁচটায়৷ আমরা তাই ছুটলাম মিউজিয়ামের দিকে৷ সেই ফাঁকে কায়রো শহরও দেখা হল খানিকটা দিনের আলোতে৷ কারয়োতে বেশির ভাগ বাড়িই দেখি অসমাপ্ত৷ প্রায় কোনো বাড়িরই প্লাস্টার নেই৷ ইঁটের কাঠামোর ওপর নতুন রঙ করা জানলার গ্রিল কদর্য ভাবে শোভা পাচ্ছে৷ ভিভিয়ান আমাদের বললো এখানে বেশির ভাগ মানুষই বাড়ি শেষ করেনা৷ কারন বাড়ি শেষ হলেই প্রপার্টি ট্যাক্স দিতে হবে৷ বাইরে থেকে যে বাড়িগুলোকে ইঁটের কঙ্কাল মনে হচ্ছে সেগুলোর ভেতরের ছবিটা একেবারেই অন্যরকম৷ মিউজিয়াম যাওয়ার রাস্তায় বেশ কিছুটা জায়গা খুঁড়ে ফ্লাইওভার বানানো হচ্ছে৷ আমার গড়িয়াহাটের কথা মনে পড়ে গেল৷ প্রচুর ট্র্যাফিক৷ এর মধ্যেই কারো কারোর সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনোর চেষ্টা৷ কলকাতার মতই অবস্থা৷ তবে কায়রোতে পাবলিক ট্রানস্পোর্ট খুব বেশি চোখে পড়লো না৷ বাস আছে৷ ট্রামও দেখেছিলাম ১৬ তারিখ রাতে৷ কিন্তু সংখ্যায় খুব বেশি নয়৷
অবশেষে আমরা যখন মিউজিয়ামে এসে পৌঁছালাম তখন সাড়ে তিনটে বেজে গেছে৷ টিকিট কেটেই সবার আগে ছুটলাম তুতানখামুনের কালেকশন দেখার জন্য৷ আগে বলা হয়নি, তাই এই সুযোগে তুতানখামুনের কথা আরেকটু বলে নিই৷ তুতানখামুনের আসল নাম তুত-আনখ-আতুম৷ তুতানখামুনের বাবা আখেন-আতুম পৌত্তলিকতার অসারতা উপলব্ধি করে একেশ্বরবাদের প্রবর্তন করেন৷ সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নাম তিনি দেন আতুম এবং সেই নামটি নিজের ও ছেলের নামের সাথে জুড়ে নেন৷ স্বাভাবিক কারনেই মিশরের পুরোহিততন্ত্রের এই পরিবর্তন পছন্দ হয়নি৷ আখেন-আতুমের মৃত্যুর পর তার কিশোর পুত্র তুত-আনখ-আতুম ফারাও হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পুরোহিততন্ত্র সফল হল তাদের পুরোনো দেবতা আমুনকে ফিরিয়ে আনতে৷ তখন থেকে তুত-আনখ-আতুমও তাঁর পুরোনো নাম পরিবর্তন করে তুত-আনখ-আমুন নামে পরিচিত হলেন৷
এবার ফিরে আসি কায়রো মিউজিয়ামে রাখা তুতানখামুনের সমাধির অতুলনীয় সম্পদের কথায়৷ ভ্যালি অফ কিংসে তুতানখামুনের সমাধিতে ঢুকেছিলাম ১৭ তারিখ৷ তারপর কায়রো মিউজিয়ামে সেই সমাধিতে যা যা পাওয়া গেছিল সেগুলো দেখলাম৷ এখনো পর্যন্ত ভেবে চলেছি ঐটুকু জায়গা যদি এতো জিনিসে ভরিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে অন্য সব নামকরা ফারাওদের অপেক্ষাকৃত বড় সমাধিগুলোতে না জানি কত সম্পদ ছিল৷ সব কিছুর বর্ণনা দেওয়া এখানে সম্ভব হবে না৷ যেগুলো প্রথম ঝটকায় মনে আসছে সেগুলো লিখি৷ প্রথমেই মনে পড়ছে দুই প্রহরীর কথা৷ ব্ল্যাক রেজিনে
এতোদিন যা শুধুই বইএর পাতায় বা ডিসকভারীর শোতে দেখেছি সেগুলো চোখের সামনে দেখেতে পেয়ে অবিশ্বাস্য লাগছিলো৷ বেশি সময় ছিল না৷ তাই ভিভিয়ান যেটুকু দেখালো সেটুকু দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল৷ পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো সাদা পাথরের স্ল্যাবের ওপর আঁকা ছবি দেখলাম৷ পাঁচটি পাখির ছবি৷ দুটি মেয়ে৷ তিনটি পুরুষ৷ কয়েকটি পাখি জলাশয়ে খুঁটে খুঁটে শিকার করছে৷ একটি সবে ওড়ার জন্য পাখনা মেলেছে৷ পাঁচহাজার বছরের পুরোনো তুলিতে সে কি গতি, রঙের কি দীপ্তি! আলতামিরার বাইসন কোনদিন দেখতে পাবো কিনা জানি না৷ কিন্তু এই পাখির ছবি দেখে মনে হল আগন্তুকে উত্পল দত্তের মুখ দিয়ে সত্যজিত্ যা বলিয়েছিলেন তা একদম ঠিক৷ এমন আঁকতে না পারলে আঁকা শেখার কোন মানেই হয় না৷ দেখলাম সেই স্ক্রাইবের মুর্তি৷ রাজসভায় যা কথা হচ্ছে সব সে লিখে নিচ্ছে৷ চোখদুটি ফারাওএর দিকে নিবদ্ধ৷ নির্নিমেষ সেই দৃষ্টি কি অসম্ভব জীবন্ত! ভিভিয়ান তার হাতের তর্চ ফেললো স্ক্রাইবের দুই চোখের মণির ওপর৷ শিউরে উঠলাম৷ এক পুরোহিতের মুর্তি দেখলাম৷ তার চুল এবং গোঁফ দুইই আছে৷ মিশরীয় পুরোহিত মাত্রেই ক্লিনশেভড - এই ধারনাটা ভুল প্রমান হল৷ শেষ কুড়ি মিনিট ভিভিয়ান আমাদের দিয়েছিল নিজেদের মত ঘুরে দেখার জন্য৷ অতো বড়ো মিউজিয়ামে কুড়ি মিনিটে আর কি হবে৷ এলোপাথারী ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষন এবং ভিভিয়ান ছাড়া যে আমরা একেবারেই অচল সেটা অনুভব করলাম বেশ ভালো ভাবেই৷ কায়রো মিউজিয়ামের কালেকশন প্রচুর হলেও ডকুমেনটেশন বিশেষ ভালো নয়৷ আমরা একটা সার্কোফেগাসের ঘরে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষন৷ ফিফটি পার্সেন্ট সার্কোফেগাস জাস্ট এমনি পড়ে আছে৷ কার সার্কোফেগাস, কোথায় পাওয়া গেছিল, যে ছবি আঁকা আছে তার অর্থ কি - এসব কিচ্ছু লেখা নেই৷ একটা কালো পাথরের স্ল্যাব দেখলাম৷ তার গায়ে এক নগ্ন শিশুর ছবি আঁকা৷ এতোদিন যা মিশরীয় আর্ট দেখেছি এ তার চেয়ে একেবারে আলাদা৷ কিন্তু কিচ্ছু লেখা নেই৷ ওটা যে কি তা আর জানা হবে না কোনদিনও৷
পরের দিন সকাল দশটায় ছিল ফ্লাইট৷ কায়রো এয়ারপোর্টের মত বিশৃঙ্খল এয়ারপোর্ট আমি আর একটাও দেখি নি৷ আমরা টার্মিনালে পৌঁছে গেছিলাম সকাল সাতটার মধ্যে৷ অজস্র বোঁচকা-বুঁচকি ঠেলে তিনবার সিকিউরিটি চেক-ইনের মধ্য দিয়ে যখন গেটে পৌঁছোলাম তখন বাজে সাড়ে নটা৷ মাঝখানে কি হল তা জানার জন্য মুজতবা আলি পড়ে নিন৷ কাবুলের রাস্তা আর কায়রো এয়ারপোর্টে বিশেষ তফাত্ নেই৷ এবং এতো কিছুর পরেও আমার ক্যারি অন লাগেজে এক বোতল জল ছিল, সেটা আমার ব্যাগেই রয়ে গেল৷ ফেরার প্লেনে চেপে বসলাম৷ রুক্ষ বালির শহর ভুমধ্যসাগরের নীলে মিশলো৷ তারপর আর কিছু দেখা গেলনা৷
7 comments:
asadharan akta lekha porlam suchismita....ki bolbo toke??...tor lekhar style ar take ato sundor kore present kora amar bhishaaaaaaaaaaaaaaaan bhalo legechhe.....ami jani akdiner moddhye tui kibhabe photoshop d/l kore chhobir upore naam gulo likhechhis......kal half porechhilam ar aj sokale shesh korlam...khub bhalo...bhobishyote aro ei rakom lekha porbo ei ashay roilam......
Suparna di
khub i shundor bornona...ami poRe khub uthshaho pachchhi Mishor visit korar...
suchismita di...osadharan ekta lekha likhecho....daruuuuuun laglo...
অনবদ্য লেখা। অনেক তথ্য ও সুন্দর ছবির সঙ্গে সাবলীল ভাষা। ভবিষ্যতে আরো অনেক জায়গায় তোমাদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে রইল।
...শুভাঙ্কুর দা
eki ami porte parchhi na keno/ eta ki bangla te lekha? tar janye ki korte habe pls amake ektu bole de Titum.
"Dekhe Jena mane hai chini uhaare"
Ki Suchismita mone porchhe ki Majlisher AsimKakuke. Tomaar Mishar bhramaner asadharan kaahinee banglate Unicodey lekhar janye porte naa pere mon kharap chhila. Seshe Suparnai uddhar korlo. Or process follow kore Unicode font instal kore tomaar eto boro asadharan apoorba bhraman kahinee pare phellam ek nishbaase. Ei samay aamaar kheyal holo, Prithibita gol aar ek jaigar manusher sathe prithibir anya kona jaigate taai dekha hoye jaai. Tomaar lekhate tomaar patidebatar naam shortey Shubha lekhatei aami tomaar sambandhe confirm holam. Mone pore gelo tomaar biyer dintir katha.
Jai hok tomaar bhramankahini porte porte aami Misharer bhitar ghure berachhilam. Hatat sesh hoye jaoate sambit phire pelam. Tomaar beranor prastutiparba theke shuru kore par par samasta jaigar bibaran ebang taar itihas bhisan sundarbhabe barnana korechha. Lokke besh dhoirjya niye eti porte habe,tabe porte paarle taara khubii khusi habe e aamaar drira biswas. Tumi aamaar sathe Orkutey nishchay jogajog koro, anek katha aachhe. Subhasishke aamaar katha bolo.
Shubharthee
Asimkaku
Suchismita,
Er aage tomaar asadharan Mishar bhramaner upor aamaar comments nishchay dekhechho. Eti Bangla Unicodey likhte besh kasta korte hoyechhe aar taar upor eto boro lekha. Banglate likhte paarle setar aalada aakarshan bere jaay, pore khub bhalo laage. Tabe tomaar lekhar samay "Surjya",Kaarjya" ityadi wordsgulo kono kaarane thik moto lekha hoi ni. Eta ki tomaar lekhar dosh naa likhan paddhatir dosh jaani naa. Bhabishyat lekhate eta najare rekho.
Asimkaku
Post a Comment